ফ্যাসিবাদ:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ইতালিতেও শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। ইতালির সর্বত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট, বেকারত্ব, হতাশা ও অবসাদ নেমে আসে।ইতালিবাসীর জীবনে এই সংকটমোচনের জন্য হাল ধরেন বেনিতো মুসোলিনি। তাঁর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দল ইতালির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। এই ফ্যাসিস্ট দলের মতবাদই ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত। লাতিন শব্দ ফাসেস (Fasces) এবং ইতালীয় ফ্যাসিও (Fascio) শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে ফ্যাসিসমো (Fascismo) শব্দটি। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ফ্যাসিজ্ম (Fascism) বাংলায় যা ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক বেনেদিত ক্রোচ-এর মতে—ফ্যাসিবাদ হল খণ্ড খণ্ড সমষ্টি ও একটি ভিত্তিহীন সংস্কৃতির দিকে পৌঁছানোর বন্ধ্যা মানসিক প্রয়াসমাত্র ।
ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ :
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। প্রথমে ফ্যাসিবাদীদের লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা। পরবর্তীকালে তাদের চরম লক্ষ্য হয়ে ওঠে শ্রমিকশ্রেণির সংগঠনগুলিকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদকে রক্ষা করা। এই কারণেই ফ্যাসিবাদকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ বলা হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্যায়ে যখন ইতালি ও জার্মানি-সদ্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্যা,পুঁজির নগ্ন প্রতিযোগিতা, শোষণ প্রভৃতি সংকটের মধ্যে পড়ে, তখন ইতালিতে মুসোলিনি ও জার্মানিতে হিটলার জনগণকে এই সংকটাপন্ন অবস্থা দূরীকরণের মিথ্যা প্রতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হন। ক্ষমতালাভের পরই ফ্যাসিবাদী শাসন শুরু হয়। ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে যেসব বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলো হলো -
- সৰ্বার ধারণা: হেগেলের সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণাকে ভিত্তি করেই ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠেছিল। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের যুপকাঠে ব্যক্তিকে বলিপ্রদত্ত বলে মনে করা হয়। এই রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্রের শুধু যে স্বাধীন সত্তা রয়েছে তাই নয়, রাষ্ট্রের একটি প্রকৃত ইচ্ছা” ও আছে, যা জনগণের ইচ্ছা থেকে একেবারে আলাদা। মুসোলিনির মতে, রাষ্ট্র জনগণের ব্যক্তিগত জীবনের ভুদ্র গণ্ডিকে অতিক্রম করে জাতির বিবেকের মূর্ত প্রতীকরূপে রাষ্ট্র কাজ করে। তাই জনগণের বিবেক হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
- একদলীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব: একদলীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ফ্যাসিবাদের একটি প্রধান উপাদান। মাসীবাদী একনায়ক হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো প্রমুখ জাতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হিসেবে একটিমাত্র দল গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। বিরোধী দল বা সংগঠনের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলার জন্যে ফ্যাসিবাদী একনায়করা গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, নির্বিচারে গ্রেফতার প্রভৃতির আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করেন না।
- জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন: ফ্যাসিবাদে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের মারসাটি ফ্যাসিবাদী একনায়করা জনগণের কাছে বারবার প্রচার করে একধরনের উন্মাদনার জন্ম দেন।হিলার যেমন শুধু জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করেছিলেন।
- রাষ্ট্রের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ: ফ্যাসিবাদ অনুসারে, শুধু ফ্যাসিস্ট দলই জনগণের সমস্যা অনুধাবনে সক্ষম।সাধারণ মানুষের পক্ষে দেশের সমস্যাগুলি বোঝা মুশকিল, তাই এক্ষেত্রে জনগণের নিষ্ক্রিয় থাকাই বাঞ্ছনীয়।ফ্যাসিবাদী যৌগ রাষ্ট্রের ধারণা অনুসারে, রাষ্ট্রের কাজকর্ম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন পেশাগত গোষ্ঠী এবং কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত হবে। এভাবে ব্যক্তির ওপর গোষ্ঠী বা কর্পোরেশনের এবং কর্পোরেশন বা গোষ্ঠীর ওপরে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েন করা হয়।
- উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা: ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি হল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ বিশুদ্ধ আর্য জাতির প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর অনার্য জাতিগুলির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে জার্মান জাতির পবিত্র কর্তব্য বলে হিটলার ঘোষণা করেছিলেন। মুসোলিনি বিশ্বশান্তিকে ‘কাপুরুষের স্বপ্ন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, স্ত্রীলোকের কাছে মাতৃত্ব যেমন কামা, পুরুষের কাছে যুদ্ধও ঠিক তাই।
- উদারনীতিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা: জনগণের সার্বভৌমত্ব, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ডোটাধিকার আইনের অনুশাসন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ, গপতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রভৃতি উদারনীতিবাদের মৌলিক উপাদানগুলিকে ফ্যাসিবাদে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।ফ্যাসিবাদ আবার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরও সম্পূর্ণ বিরোধী। ফ্যাসিবাদ মনে করে, ব্যক্তির স্বার্থ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে স্বীকার করা হয় না। ফ্যাসিবাদ অনুসারে,রাষ্ট্রের ইচ্ছার সঙ্গে একাবতা স্থাপনের মাধ্যমে নাগরিকরা ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। রাষ্ট্রের ইচ্ছার বাইরে ব্যক্তির কোনো স্বতন্ত্র ইচ্ছা থাকতে পারে না বলে ফ্যাসিবাদ বিশ্বাস করে। ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রেরও কট্টর বিরোধী।
- অভিজ্ঞাত বা এলিটদের প্রাধানা: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রকৃতিগতভাবে অভিজাততন্ত্রে বিশ্বাসী। মুষ্টিমেয় এগি বা অভিজাতবর্গের রাষ্ট্রশাসনের যোগ্যতা আছে বলে ফ্যাসিবাদে মনে করা হয়। এই অভিজ্ঞাতবর্গের ওপরে থাকেন সকল জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা দল ও রাষ্ট্রের নায়ক। এই দলনায়ক বা রাষ্ট্রনায়ক হলেন ‘অতিমানব’:নিটসের তত্ত্ব অনুসারে এই অতিমানব সমস্ত ভুলভ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে। ইতালিতে মুসোলিনি এবং জার্মানিতে হিটলার ছিলেন এ ধরনের অতিমানব।
- নারীস্বাধীনতার চরম বিরোধিতা: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে নারীস্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়নি। গ্রীপুরুষনির্বিশেষে সমানাধিকারের বিষয়টি ফ্যাসিবাসে উপেক্ষা করা হয়। হিটলার এবং মুসোলিনি—এই দুই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কের অভিমত ছিল, গৃহকোণই নারীদের আদর্শ স্থান। তাঁরা মনে করতেন, নতুন প্রজন্মের বীর যোদ্ধাদের জন্ম দেওয়া ও লালনপালন করাই নারীদের একমাত্র কাজ।
- নাগরিক স্বাধীনতার বিরোধিতা: ফ্যাসিবাদ নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সমাজের মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির ডোঙাধিকার স্বীকৃত হয়। বলা হয় রাষ্ট্রকে যারা অর্থ দেবে তারাই ভোটাধিকার পাবে। গণতন্ত্রের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ এক কঠোর শৃঙ্খলা, দায়িত্ব আর স্তরবিন্যাসের কথা প্রচার করে। এখানে রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগতাই হল স্বাধীনতা।
- পুঁজিবাদী অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতা: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেয়।ফ্যাসিবাদ এমন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলে যেখানে কোনো ধরনের বিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। শ্রমিকদের কোনো ধরনের বিক্ষোভ বা ধর্মঘটের অধিকার এখানে স্বীকৃত নয়। ফ্যাসিবাদ যে আর্থিক নীতি গ্রহণ করে তার ফলে শুধু পুঁজিপতি শ্রেণি লাভবান হয়ে থাকেন।