সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব লেখো

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব :


পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব লেখো


পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। অধিকাংশ মারাঠা ঐতিহাসিক এই যুদ্ধকে গুরুত্বহীন একটি ঘটনা রূপে তুলে ধরেছেন। তাদের মতে এই যুদ্ধে কয়েকজন প্রথম সারির মারাঠা সামরিক নেতার প্রাণহানি ছাড়া মারাঠা শক্তি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। বিজয়ী আহম্মদ শাহ আবদালীও ভারতে কোনো সাম্রাজ্য গঠন করতে পারেন নি। বরং যুদ্ধের পর তিনি মারাঠাদের সঙ্গে একটি মিত্রতা চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এছাড়া মারাঠা ঐতিহাসিকরা আরো বলেছেন, পানিপথের যুদ্ধের ফলে মারাঠা শক্তি ধ্বংস হয়নি। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কিছুদিনের মধ্যেই মাধব রাও, নানা ফড়নবিশ, মহাদজি সিন্ধিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে মারাঠারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে মারাঠাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি তুলে ধরেছিল। তাই ঐতিহাসিক সরদেশাই লিখেছেন, "The disaster of Panipath decided nothing. "

অন্যদিকে মারাঠা ঐতিহাসিকদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে স্যার যদুনাথ সরকার স্পষ্টভাবে বলেছেন, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাগ্য ভবিষ্যতে কোনদিকে প্রবাহিত হবে তা পানিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন, “It was, in short, a nationwide disaster like Flodden Field, there was not A home in Maharashtra that had not go mourn the loss of a member. An entire generation of leaders were cut off at one stroke." ডক্টর কালীকিংকর দত্তের মতে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ মারাঠাদের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছিল এবং মারাঠা সাম্রাজ্যবাদের গতিকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছিল। ঐতিহাসিক পুনতামরেকারের মতে, “It proved a great setback to their political ambition.” ঐতিহাসিক পার্শিভাল স্পিয়ার বলেছেন, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারির পানিপথের যুদ্ধ কেবলমাত্র মারাঠাদের পরাজয় ছিল না, মারাঠা জাতির স্বার্থ বিপন্ন করে তুলেছিল।

প্রকৃত বিচারে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠারা নানাদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের পুত্র বিশ্বাস রাও, ভ্রাতুষ্পুত্র সদাশিব রাও সহ বহু মারাঠা নেতা আফগান বাহিনীর হাতে নিহত হন। প্রায় ২৮ হাজার মারাঠা সেনা এই যুদ্ধে নিহত হন। এই যুদ্ধে মারাঠাদের ৫০ হাজার ঘোড়া, ২ লক্ষ গোরু, মোষ, কয়েক হাজার উট, ৫০০ হাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিজয়ী আফগানরা প্রভূত পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। পানিপথের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পেশোয়া বালাজি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যান। স্টুয়ার্ট গর্ডন তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণামূলক গ্রন্থ 'The Marathas-এ লিখেছেন যে, মারাঠারা যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা যেসব এলাকা থেকে অনিয়মিত কর আদায় করত সেইসব অঞ্চলেই পানিপথের যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল। যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয়ের পর এই সব অঞ্চলের স্থানীয় প্রধানরা মারাঠারা বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছিল। মারাঠা শক্তির মর্যাদা অনেকাংশেই ক্ষুণ্ন হয়েছিল। ফলে গোটা ভারত জুড়ে মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার আসা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র তাই লিখেছেন, “The Third Battle of Panipath did not decide who who to rule India, but rather who was not.” একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় ভারতে ইংরেজ উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল। মারাঠারা যে অপরাজেয় নয় তা স্পষ্ট হয়। ফলে ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য গঠনের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল। সুতরাং একথা অস্বীকার করা যাবে না যে অষ্টাদশ শতকের ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে পলাশির যুদ্ধ ভারতে যদি ব্রিটিশ আধিপত্যের বীজ বপন করে থাকে তবে পানিপতের তৃতীয় যুদ্ধ তাকে শিকড় বিস্তার করে পরিণত হওয়ার সময় করে দিয়েছিল।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

খুত ও মুকদ্দম কাদের বলা হত? কে, কেন তাদের কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করেন ?

খুত ও মুকদ্দম         বাজার দর নিয়ন্ত্রণ এবং জীবন নির্বাহের ব্যয় হ্রাস করেই আলাউদ্দিন খলজি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য সচেষ্টও হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। রাষ্ট্রের অধীনে খাদ্য ও জমি বৃদ্ধির জন্য তিনি সর্বপ্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর অবলম্বন করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায় ও ধার্মিক ব্যক্তিদের মিলক্, ইনাম, ইদ্দ্ররাৎ এবং ওয়াকফ জমি রাষ্ট্রের অধীনে পুনরায় আনয়নের চেষ্টা করেন। মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়র ও ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরই সুলতান অলাউদ্দিন খলজি খুত, চৌধুরী ও মুকদ্দম নামে পরিচিত হিন্দু অভিজাতবর্গের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। “খুত” শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও সম্ভবত পরবর্তীকালে যার জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করেন আলাউদ্দিনের-রাজত্বকালে তাঁরা খুত নামে পরিচিত ছিলেন। “চৌধুরী” ছিলেন পরগণার প্রধান ব্যক্তি এবং “মুকদ্দম” ছিলেন গ্রামের প্রধান। রাষ্ট্রের প্...