ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') !

পটভূমি / কারণ  

ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো – 

[1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজির হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলায় ভারতবাসীর সক্রিয় সাহায্যলাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার ব্যগ্ৰ হয়ে ওঠে। 

[2] প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ : মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটেনের শ্রমিক দলের (Labour Party) নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ও অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদগণ যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন। ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ঘোষণার জন্য তারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেন। চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাইশেকও ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে অনুরোধ জানান। 

[3] ভারতের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী গণবিদ্রোহ শুরু হলে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। অপরদিকে মিত্রপক্ষভুক্ত ব্রিটিশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে তার ঔপনিবেশিক শক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য ক্রিপস্ তার একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন।

ক্রিপস্ মিশনের প্রস্তাব 

ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি ছিল —  
  1. যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Union) প্রতিষ্ঠা করা হবে। 
  2. ওই যুক্তরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার 'ডোমিনিয়ন'-এর মর্যাদা দান। করা হবে। 
  3. যুদ্ধশেষে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ রচিত সংবিধান প্রবর্তন করা হবে। 
  4. অবিলম্বে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বড়োলাটের শাসনপরিষদে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হবে। 
  5. সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান চালু হবে। 
  6. কোনো প্রদেশের গণপরিষদ রচিত সংবিধান পছন্দ না হলে সেই প্রদেশটি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। 
  7. সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। বিনিময়ে তারা ভারতের সম্পদ ব্যবহার করবে।

ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

ক্রিপস্ মিশনের প্রস্তাবগুলি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন দিক থেকে প্রস্তাবগুলির বিরূপ সমালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলি সেগুলির গ্রহণযোগ্যতাকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ২৯ মার্চ (১৯৪২ খ্রি.) এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস্ যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন-সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি ১১ এপ্রিল আর এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেগুলি সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিক্রিয়ার ধরন লক্ষ্য করা যাক — 

[1] কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারতের স্থলে বহুধাবিভক্ত ভারতের অর্থাৎ দেশ বিভাগের সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় ক্রিপস প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।

[2] মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া: লিগের প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্য দু'রকমের সন্তোষজনক, আবার হতাশাব্যঞ্জক। প্রদেশগুলিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়ায় লিগ খুশি হলেও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের অর্থাৎ 'পাকিস্তান' দাবি স্বীকৃত না হওয়ায়, সে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

[3] শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া : ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ও ক্রিপস্ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে।

[4] হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া : হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, ক্রিপস প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

[5] ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া: ইঙ্গ- ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ও এই প্রস্তাবের ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব বোধ করে।

সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করায় এই প্রস্তাব শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আসলে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায় কারুর কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন – ‘এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক কাটার শামিল।’ এইভাবে ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতীয়দের তীব্র প্রতিক্রিয়া একদিকে যেমন মিশনের ব্যর্থতাকে প্রকট করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটিশকে বুঝিয়ে দেয় যে, এদেশে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন