গৌরবময় বিপ্লব
রজবংশের শেষ রাজ দ্বিতীয় জেমসের সিংহাসন ত্যাগ এবং তৃতীয় উইলিয়াম ও রানী মেরীর ইংল্যান্ডের সিংহাসন আরোহণের ঘটনা ১৬৮৮ খ্রিস্টান্সের রক্তহীন বিপ্লব বা গৌরবময় বিপ্লব নামে পরিচিত। স্টুয়ার্ট রাজবংশের সিংহাসন লাভের এর পর থেকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে যে রাজনৈতিক জটিল প্রশ্ন দেখা দেয় এই বিপ্লবের ফলে তার অবসান ঘটে। রাজমুকুট ও পার্লামেন্টের সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত পার্লিয়ামেন্ট জয়লাভ করে। প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে বিচার করলে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের ইংল্যান্ডের বিপ্লবের সঙ্গে তুলনীয় কোন বিপ্লব ইয়োরোপের ইতিহাস আর কোথাও ঘটেনি। এই বিপ্লব ছিল রক্তপাতহীন এবং এর লক্ষাও ছিল প্রচণ্ড সংরক্ষণশীল। হুইগ ও টোরি নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ যারা এই বিপ্লবের পটভূমিকা রচনা করেন এবং এই বিপ্লবকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরা কেউ মৌলিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে বা রাজনৈতিক মতবাদ বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থার কোন পরিবর্তন করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল খুবই সীমিত। প্রকৃতপক্ষে রাজা দ্বিতীয় জেমস সংবিধানের কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে ধবংস করতে চেয়েছিলেন এবং বিপ্লবের সংগঠকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই সব ধারা পুনরুদ্ধার করা। অন্যভাবে বলা যায় যে, পুরাতন সংবিধানকে অবিকৃতভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেন এবং রাজা দ্বিতীয় জেমস যে ভাবে সংবিধানের বিভিন্ন ধারার উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন, ভবিষ্যতে আর যাতে কেউ তা না করতে পারেন, সেজন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লর প্রকৃতিগতভাবে ছিল রক্ষণশীল এবং এর উদ্দেশ্য ছিল পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ, কিন্তু নতুন কিছু প্রবর্তন নয়।
‘বিল অফ রাইটস’ এবং ‘অ্যাক্ট অফ সেটেলমেন্টের’ মাধ্যমে রক্তহীন বিপ্লবের ফলে বিধিবদ্ধ সাংবিধানিক পরিবর্তন সমূহ আইনে পরিণত করার ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় চার্লস ও দ্বিতীয় জেমস যে সব উপায়ে পার্লিয়ামেন্টকে প্রভাবিত করাতে বা পার্লিয়ামেন্টকে অকেজো করে রাখার চেষ্টা করতেন এই দুটি সংবিধান দলিলে এবং ট্রিয়েনিয়াল অ্যাক্ট (Triennial Act) সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়াস দেখা যায়। ট্রিয়েনিয়াল অ্যাক্ট অনুযায়ী স্থির হয় যে কোনও একটি পার্লিয়ামেন্টের আয়ুষ্কাল তিন বছরের বেশি হতে পারবে না এবং তিন বছরের বেশি সময় কখনই পার্লিয়ামেন্ট-এর নির্বাচন স্থগিত রাখা যাবে না। তবে বিপ্লবোত্তর বিধিবদ্ধ শর্তসমূহ কোনক্রমেই এই সময়ের সাংবিধানিক পরিবর্তনের সম্পূর্ণ চিত্র প্রতিফলিত করে না। প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের মৌলিক ফলশ্রুতি ছিল রাজনৈতিক ভারসাম্য রাজার হাত থেকে পার্লিয়ামেন্টের উপর স্থাপন করা। ১৬৪০-১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘লং পালিয়ামেন্টের’ আমলেই এই পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গৌরবময় বিপ্লবের যুগের সাংবিধানিক বন্দোবস্ত থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই বিপ্লবের পূর্ববর্তী সাংবিধানিক বন্দোবস্তগুলোকে লোকে ধবংস না করে এবং এগুলোকে সুনির্দিষ্ট ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় চার্লস ও দ্বিতীয় জেমস-এর আমলের দ্বিতীয় স্টুয়ার্ট স্বৈরাচারিতা সাময়িক ঘটনা এবং অতীতকে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। গৌরবময় বিপ্লব স্টুয়ার্ট রাজাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার অসারতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে স্বমহিমায় পূনঃপ্রতিষ্ঠা করায় উদ্দেশ্য নিয়ে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সাফল্যমণ্ডিত হলেও এই সাফল্যের মধ্যে গৌরবজনক উপাদান ছিল খুবই নগণ্য।