সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চৌথ, সরদেশমুখী এবং সরঞ্জাম শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করো।

চৌথ, সরদেশমুখী এবং সরঞ্জাম :


চৌথ, সরদেশমুখী এবং সরঞ্জাম শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করো।


চৌথ ও সরদেশমুখী:  ভূমিরাজস্ব  ছাড়া  শিবাজি প্রবর্তিত দুটি কর ছিল চৌথ ও সরদেশমুখী। শিবাজি তাঁর বিরাট সেনাবাহিনীর জন্য আর্থিক সংস্থানের জন্য প্রতিবেশি অঞ্চল, বিজাপুর ও মুঘল অধিকৃত অঞ্চলের কয়েকটি জেলা থেকে ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ নামে দুটি কর আদায়ের নীতি কার্যকর করেন। ‘চৌথ’ ছিল রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ। ‘সরদেশমুখী’ ছিল এক-দশামংশ। যে সকল অঞ্চল স্বেচ্ছায় ‘চৌথ’ দিত না, তারা মারাঠা অশ্বারোহী সেনার দ্বারা আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হত। আসলে মারাঠা আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতিলাভের জন্য ‘নিষ্কৃতি কর’ হিসাবে চৌথ ও সরদেশমুখী পরিগণিত হয়। ঐতিহাসিক রাণাডের মতে, অন্য কোনো তৃতীয় শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিবেশী রাজ্য থেকে এই কর আদায় করা হত। কিন্তু সরদেশাই লিখেছেন, শত্রু বা বিজিত রাজ্য থেকে ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ আদায় করা হত। কিন্তু স্যার যদুনাথ সরকার এই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর যে অঞ্চল থেকে আদায় করা হত সেই অঞ্চল মারাঠা আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেত। তিনি শিবাজির ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়কে লুণ্ঠন বলে মনে করেন। তাঁর মতে, শিবাজির ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়কে মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে শিবাজির সুনাম নষ্ট হয়। মারাঠাদের মানুষ দস্যু বলে মনে করতে থাকে। স্যার যদুনাথ সরকার আরো লিখেছেন, আভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষা বা বিদেশি শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার কোনো প্রতিশ্রুতি ‘চৌথ’ আদায়ের শর্ত ছিল না। এই কারণে চৌথ আদায় ভুক্ত অঞ্চলগুলিকে যথার্থভাবে মারাঠা অঞ্চল বলা যায় না। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথও ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ করকে ‘দস্যুকর’ বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে শিবাজির ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায় নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তবে বলপূর্বক ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়ের মাধ্যমে সমগ্র মারাঠা জাতিকে শিবাজি সংগ্রামশীল করে তুলেছিলেন। মারাঠা জাতির মধ্যে অনেক অনৈক্য থাকা সত্ত্বেও ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ কর আদায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন তাদের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যদিকে তেমনি মারাঠাদের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছিল। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মারাঠা সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেনাবাহিনীকে একটি সংগঠিত ও সুসংহত করা সম্ভব হয়েছিল।

সরঞ্জাম: শিবাজি সৈন্যদের নগদ বেতন দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তবে শিবাজি সেনাবাহিনীর অফিসারদের জাগির প্রদান করতেন। একে বলা হত ‘সরঞ্জাম’। এমনকি মারাঠা সামন্তরাও সামরিক সেবার বিনিময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাগির জমি বা ‘সরঞ্জাম’ লাভ করতেন। যেসব মারাঠা সামরিক সর্দার বা সামন্ত জাগির পেতেন তাদের বলা হত ‘সরঞ্জামদার’। শিবাজির ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল সরঞ্জামব্যবস্থা।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

খুত ও মুকদ্দম কাদের বলা হত? কে, কেন তাদের কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করেন ?

খুত ও মুকদ্দম         বাজার দর নিয়ন্ত্রণ এবং জীবন নির্বাহের ব্যয় হ্রাস করেই আলাউদ্দিন খলজি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য সচেষ্টও হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। রাষ্ট্রের অধীনে খাদ্য ও জমি বৃদ্ধির জন্য তিনি সর্বপ্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর অবলম্বন করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায় ও ধার্মিক ব্যক্তিদের মিলক্, ইনাম, ইদ্দ্ররাৎ এবং ওয়াকফ জমি রাষ্ট্রের অধীনে পুনরায় আনয়নের চেষ্টা করেন। মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়র ও ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরই সুলতান অলাউদ্দিন খলজি খুত, চৌধুরী ও মুকদ্দম নামে পরিচিত হিন্দু অভিজাতবর্গের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। “খুত” শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও সম্ভবত পরবর্তীকালে যার জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করেন আলাউদ্দিনের-রাজত্বকালে তাঁরা খুত নামে পরিচিত ছিলেন। “চৌধুরী” ছিলেন পরগণার প্রধান ব্যক্তি এবং “মুকদ্দম” ছিলেন গ্রামের প্রধান। রাষ্ট্রের প্...