সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খলজি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মালিক কাফুরের ভূমিকা আলোচনা কর।

খলজি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মালিক কাফুরের ভূমিকা

খলজি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মালিক কাফুরের ভূমিকা আলোচনা কর।


         আলাউদ্দিন খলজিই সর্বপ্রথম দক্ষিণ ভারতে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তাঁর পূর্বে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল, তথাপি তিনিই দক্ষিণ ভারতকে দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। আলাউদ্দিনের দক্ষিণ ভারত অভিযানে রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত ছিল। সোম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের অতুলনীয় ঐশ্বর্যও তাঁকে প্রলুব্ধ করেছিল। দক্ষিণ ভারতে খলজিদের আধিপত্য বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন সেনাপতি মালিক কাফুর। এই সময় দক্ষিণ ভারতে চারটি হিন্দুরাজ্য ছিল-দেবগিরির যাদব, বরঙ্গলের কাকতীয়, দ্বারসমুদ্রের হোয়সল এবং সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্যগণ।

      ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজি দেবগিরির বিরুদ্ধে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান শুরু করেন। দেবগিরিরাজ রামচন্দ্রদেব কর দেওয়া বন্ধ করেছিলেন এবং গুজরাটের রাজা কর্ণদেবকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, এই অভিযোগে আলাউদ্দিন খলজি দেবগিরি আক্রমণ করেন। রামচন্দ্রদেব যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে বরঙ্গলের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠান। এই অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বরঙ্গল রাজ্যের ধন-সম্পদ হস্তগত করা। কাকতীয়রাজ প্রতাপরুদ্রদেব যুদ্ধে পরাজিত হন এবং মালিক কাফুরকে প্রচুর ধন-রত্ন দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষাপান।

            এরপর   জয়লাভ   করে   উচ্চাভিলাষী আলাউদ্দিনের বিজয় আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়। ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুদূর দক্ষিণের দ্বারসমুদ্রের হোয়সলরাজের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে প্রতাপরুদ্রদেব এবং রামচন্দ্রদেব সুলতানী বাহিনীকে সাহায্য করেন। হোয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লার যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব ভেবে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি প্রচুর ধনরত্ন মালিক কাফুরকে অর্পণ করেন ও বার্ষিক করদানে স্বীকৃত হন। এরপর সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্যরাজ্য খলজি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। কিন্তু পাণ্ডরাজ সুন্দর পাণ্ড্য ও বীর পাণ্ড্যকে যুদ্ধে পরাজিত করা সুলতানী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মালিক কাফুর ক্রুদ্ধ হয়ে অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন এবং অপরিমিত ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতের অভিযান সমাপ্ত করে মালিক কাফুর দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে রামচন্দ্রদেবের পুত্র শঙ্করদেব (সিংঘন) বিদ্রোহী হয়ে উঠলে মালিক কাফুর পুনরায় দেবগিরি আক্রমণ করে এই রাজ্যটিকে আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এইভাবে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে আলাউদ্দিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

খুত ও মুকদ্দম কাদের বলা হত? কে, কেন তাদের কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করেন ?

খুত ও মুকদ্দম         বাজার দর নিয়ন্ত্রণ এবং জীবন নির্বাহের ব্যয় হ্রাস করেই আলাউদ্দিন খলজি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য সচেষ্টও হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। রাষ্ট্রের অধীনে খাদ্য ও জমি বৃদ্ধির জন্য তিনি সর্বপ্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর অবলম্বন করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায় ও ধার্মিক ব্যক্তিদের মিলক্, ইনাম, ইদ্দ্ররাৎ এবং ওয়াকফ জমি রাষ্ট্রের অধীনে পুনরায় আনয়নের চেষ্টা করেন। মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়র ও ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরই সুলতান অলাউদ্দিন খলজি খুত, চৌধুরী ও মুকদ্দম নামে পরিচিত হিন্দু অভিজাতবর্গের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। “খুত” শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও সম্ভবত পরবর্তীকালে যার জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করেন আলাউদ্দিনের-রাজত্বকালে তাঁরা খুত নামে পরিচিত ছিলেন। “চৌধুরী” ছিলেন পরগণার প্রধান ব্যক্তি এবং “মুকদ্দম” ছিলেন গ্রামের প্রধান। রাষ্ট্রের প্...