সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা


       সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।

       ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কৃষিজীবী মানুষকে বলপূর্বক ভূমিদাসে পরিণত করা হয়েছিল।

    পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে ম্যানর প্রথার বিস্তার ঘটেছিল। কোনো কোনো ম্যানরে সম্পূর্ণ নিয়োজিত ছিল ভূমিদাসরা, আবার কোথাও ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র স্বাধীন কৃষকদের অস্তিত্ব ছিল। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অনেক অঞ্চলে ম্যানর ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। ম্যানর প্রথা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একজন মাত্র প্রভুর অধীনে থাকে একটি অনুগত মানব গোষ্ঠী। ম্যানর ছিল সামন্তপ্রভুর খাজনা আদায়ের মূল ভাণ্ডার, তাই বলা হয়ে থাকে প্রভুর অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ম্যানর গড়ে তোলা হয়েছিল। ম্যানরে অধীনস্থ জনগণকে সামস্তপ্রভুরা জোর করে কর চাপাতেন এবং তাদেরকে অনেক সময় বেগার খাটতে বাধ্য করতেন।

      গ্রামই হল একটি ম্যানরের কেন্দ্র। ম্যানর ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। একটি ম্যানরের অন্তর্ভুক্ত জনগণের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর দ্রব্যসম্ভার এখানে উৎপাদিত হত। তাই ম্যানরগুলি ছিল সাজানো গোছানো। ম্যানরের একদিকে ছিল কৃষকদের সারিবদ্ধ কুঁড়ে ঘরগুলি। যেগুলি নির্মিত হত পথের ধারে। এই বাড়িগুলির চারপাশে থাকত সবজি বাগান, হাঁস, মুরগির খাবার ও আস্তাবল। ম্যানরের অন্যদিকে থাকত চার্চ যেখানে অবস্থিত ছিল যাজকের ঘর ও কবরখানা। বড়ো ম্যানরের সামস্তপ্রভুর দুর্গ সুরক্ষিত কেন্দ্রে থাকত প্রাসাদ। এছাড়াও ম্যানরে থাকত কারিগরদের কারখানা ও রুটি তৈরির বেকারি।

     ম্যানরের প্রশাসন পরিচালনার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকজন কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হত। এদের উপাধি ছিল স্টুয়ার্ড, বাইলিফ এবং রিভ। ম্যানরের সকল সম্পত্তির দেখাশোনার কর্মকর্তা ছিলেন স্টুয়ার্ড। তিনি বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের তত্ত্বাবধান করতেন। স্টুয়ার্ডের আদালতে বিচার অনুযায়ী অপরাধীকে জরিমানা দিতে হত। ম্যানরের স্থায়ী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োজিত থাকতেন বাইলিফগণ, যারা ছিলেন লর্ড বা প্রভুর প্রতিনিধি। রিভ পদটা অনেকটা মধ্যস্থতাকারী পদ। এই শ্রেণির কর্মকর্তা জনগণের সুখ-দুঃখের অভিযোগ সামন্তপ্রভুর কাছে পৌঁছে দিতেন।

      রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ম্যানর ব্যবস্থা ছিল সামস্তুতন্ত্রের পরিবর্ধনশীল রূপ। মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ম্যানরের কৃষক ও ভূমিদাসদের শোষিত ও অত্যাচারিত জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। অধীনস্থ জনগণের উপর লর্ড বা সামন্তপ্রভুরা পশুর ন্যায় অত্যাচার করলেও তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতির কোনো পথ ছিল না। দ্বাদশ শতকের পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন নগর গড়ে ওঠার ফলে ম্যানরের অত্যাচারিত জনগণ শহরগুলিতে আশ্রয় নিতে থাকে। শ্রমশক্তির অভাবে ম্যানরের উৎপাদন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের রূপান্তর ঘটে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...