সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঠান্ডা লড়াই-এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য লেখো।

ঠান্ডা লড়াই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একদিকে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য এই দুই রাষ্ট্রজোটের মধ্যে যে গোপন লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘The Cold War’ গ্ৰন্থে সর্বপ্রথম ‘ঠান্ডা লড়াই’ কথাটি ব্যবহার করেন।

ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রকৃতি

বিশ্বে জুড়ে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে—

  1. যুদ্ধপরিবেশ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় পক্ষই নিজেদের মধ্যে সরাসরি কোনো শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ না হলেও এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলিকে পরোক্ষভাবে মদত দিয়ে যুদ্ধের বাতাবরণ বজায় রেখেছিল। এসময় উভয় পক্ষই বিপজ্জনক পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।
  2. সংঘর্ষহীনতা: উদ্দেশ্যমূলক প্রচার, অন্তর্ঘাত, এমনকি সীমিত কিছু নাশকতামূলক কাজকর্মকে ঠান্ডা লড়াই উৎসাহ দিলেও কোনো ক্ষেত্রেই তা শেষপর্যন্ত ব্যাপক সংঘর্ষে পরিণত হয়নি। উভয়পক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনা থাকলেও যুদ্ধের মর্মান্তিক পরিণতির ব্যাপারে উভয়েই ছিল সতর্ক। ফলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ঘটেনি।
  3. আদর্শগত দ্বন্দ্ব : ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা যায়। একদিকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদের প্রসার অপরদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী আগ্রাসনে তীব্র আদর্শগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
  4. প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি : অস্ত্র প্রতিযোগিতার দরুন উভয় পক্ষেরই বার্ষিক প্রতিরক্ষা ব্যয় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল।
  5. ভৌগোলিক বিভাজন: ঠান্ডা লড়াই-এর রাজনীতি ভৌগোলিক বিভাজন ঘটায়। একনিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো, মেডো, সেন্টো, সিয়েটো, অ্যাজাস প্রভৃতি রাষ্ট্রজোট গঠিত হলে তার প্রত্যুত্তরে রাশিয়া গঠন করে কমিবন, ওয়ারশ চুক্তি সংস্থার মতো রাষ্ট্রজোট। ফলে স্পষ্টতই ভৌগোলিক দিক থেকে বিভাজন ঘটে যায়।
  6. মন্তব্য: ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি বিশ্লেষণে বলা যায় যে, এটি আসলে যুদ্ধও নয়, শান্তিও নয়। যুদ্ধ ও শান্তির মাঝামাঝি এক অস্বস্তিকর অবস্থা। তাই বলা চলে ঠান্ডা যুদ্ধ হল এক যুদ্ধহীন যুদ্ধ। ঠান্ডা যুদ্ধের অপর নাম দেওয়া হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধ (War of Nerves)। বার্নেট ঠান্ডা যুদ্ধকে গরম শান্তি বলে উল্লেখ করেছেন। জন কেনেডি ঠান্ডা যুদ্ধকে শক্ত ও তিত্ব শান্তি বলেছেন।

ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে হয়ে ওঠে ‘ঠান্ডা লড়াই”। ঠান্ডা লড়াইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-

  1. কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের। তাই ঠান্ডা লড়াই বলতে বোঝায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে।
  2. বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের দ্বন্দ্ব : উভয় রাষ্ট্রই বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ও তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে তৎপর ছিল। বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের | দ্বন্দ্বকে ঘিরে উদ্ভব ঘটে দ্বিমেরু রাজনীতির।
  3. রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও সাম্যবাদের পক্ষে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এর পরিণতি হিসেবে ঠান্ডা লড়াই নামে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই শুরু হয়।
  4. সামরিক বলবৃদ্ধি: কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে দুই শক্তিজোট ভিতরে ভিতরে জোর সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে। প্রবল থেকে প্রবলতর শক্তিসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও সেগুলির পরীক্ষার নামে যুদ্ধ মহড়া শুরু হয় দুই শিবিরে। এইভাবে উভয়পক্ষই প্রবল সামরিক বলে তান্ত্রিক বলীয়ান হয়ে ওঠে। বিশ্বে আতঙ্কজনক বাতাবরণ গড়ে ওঠে, যা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত হয়।
  5. সীমাবদ্ধতা: দু-পক্ষেরই অনুগত কোনো রাষ্ট্র কোনো অঞ্চলে যুদ্ধরত হলে ওই যুদ্ধকে ওই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ রাখতে উভয়েই তৎপর হয়ে ওঠে।
  6. ছায়া যুদ্ধ: আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনো পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি। কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...