মিথ (উপকথা) ও লেজেন্ড (পুরাকাহিনি) বলতে কী বোঝ ? অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে এরা কীভাবে রূপদান করে ?

পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ

সংজ্ঞা: সৃষ্টির আদিমকালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনি রচনা ও প্রচার করে তাকে পৌরাণিক কাহিনি বা লোকপুরাণ (Myth) বলে। লোকপুরাণগুলি লোকসমাজের দ্বারা মৌখিকভাবে সুপ্রাচীন অতীত থেকে রচিত হয়ে আসছে। ‘Myth' শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'Muthos' থেকে।

কিংবদন্তির সংজ্ঞা

সংঞ্জা: সাধারণত বিশেষ কোনো অঞ্চলে সংঘটিত কোনো ঘটনা বা চরিত্রকেন্দ্রিক কাহিনি যা সেই অঞ্চলের মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় মনে রাখে এবং বিশ্বাস করে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করে, তাকে কিংবদন্তি বলে। মৌখিক ইতিহাসে এক প্রধান উপাদান হল কিংবদন্তির কাহিনি বা বীরগাথা । সত্য, মিথ্যা, সম্ভাবনা—এই তিনের মিলিত সমষ্টি কিংবদন্তি। পুরাকালে বিশেষ কোনো ভোজ উৎসবে কোনো সন্ন্যাসী বা ধর্মগুরুর যে সমস্ত জীবনবৃত্তান্ত কথিত বা গীত হত তাকে কিংবদন্তি বলা হত। ব্লুমসবেরি ইংরেজি অভিধানে কিংবদন্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে—কিংবদন্তি হল এমন এক গল্প যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপস্থাপিত হয়েছে ইতিহাসরূপে, আসলে যা সত্যি নয়। মারিয়া লিচ সম্পাদিত 'Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legend' গ্রন্থে বলা হয়েছে “কিংবদন্তি একটি বর্ণিত বিষয়রূপেই প্রচলিত হয়েছে, যা ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যগত উপাদান, যাতে কোনো ব্যক্তি, স্থান অথবা ঘটনার কথাই বলা হয়।”

অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে মিথ-এর রূপদান

মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। যেমন—

(1) অতীতের সঞ্চালন: জে. এফ. বিয়ারলেইন মনে করেন যে, মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি হল “গল্পের আকারে (কোনো মানব সংস্কৃতির) সত্য ঘটনার প্রকাশ।” অর্থাৎ অতীতের বিভিন্ন ঘটনা পৌরাণিক কাহিনিগুলির মাধ্যমে বংশপরম্পরায় গল্পের আকারে বর্তমান মানুষের কাছে সঞ্চালিত হয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— প্রাচীন গ্রিসের মিথের সূত্র ধরেই বর্তমানকালের ট্রয় নগরী ও ট্রয়ের যুদ্ধ- ক্ষেত্রের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।

(2) সময়কাল নির্ণয়: বিভিন্ন মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলি তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই করে ইতিহাসের বহু সাল-তারিখ জানা সম্ভব হয়। ফলে অতীতের ধারাবাহিক ছবি মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।

(3) বংশলতিকা: অতীতকালের বিভিন্ন রাজবংশের বংশলতিকা বহু মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিতে পাওয়া যায়। এগুলি থেকে বিভিন্ন রাজবংশ, রাজার নাম ও পরিচয় জানা যায়। ড. রণবীর চক্রবর্তী মনে করেন যে, পুরাণে বর্ণিত রাজবংশগুলির অস্তিত্বের বেশিরভাগই স্বীকৃত সত্য। 4 ধারাবাহিকতা: প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে যেসব আধুনিক মানব সংস্কৃতির উৎপত্তি হয়েছে তারা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয় যে, প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যেসব ঘটনা প্রচলিত রয়েছে সুেগলি সত্য। যেমন—বর্তমানকালের হিন্দু সম্প্রদায় প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতিকে নিজেদের অতীত সংস্কৃতি বলে মনে করে।

অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে কিংবদন্তির রুপদান 

প্রচলিত কিংবদন্তিগুলি অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। যেমন—

(1) সত্যতা: কিংবদন্তির কাহিনিগুলিকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলা যায় না। বহু ক্ষেত্রে এগুলিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাস্তব ঘটনার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন—বাংলার কিংবদন্তি চরিত্র রঘু ডাকাতের কালীপুজোর ভিত্তিতে আজও একটি কালী মন্দিরকে চিহ্নিত করা হয়।

(2) ঐতিহাসিক তথ্য: প্রচলিত কিংবদন্তিগুলি থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র পাওয়া যেতে পারে। যেমন— পূর্ববঙ্গের সীতারকোট, বেহুলার বাসরঘর, অরুণধাপ ঢিবি, টুঙ্গির শহর ঢিবি প্রভৃতি স্থান সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তির সূত্র থেকে নানা ইতিহাস জানা যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন