ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ট্রুম্যান নীতি

সূচনা : সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদী আদর্শের বিস্তার রোধ করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান যে নীতি ঘোষণা করেন (১৯৪৭ খ্রি., ১২ মার্চ) তা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত এবং তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী জর্জ মার্শাল যে নীতি ঘোষণা করেন (১৯৪৭ খ্রি., ৫ জুন) তা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত।

মূল বক্তব্য : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন সংসদের এক যৌথ অধিবেশনে ট্রুম্যান বলেন এখন থেকে পৃথিবীর যে-কোনো জায়গার স্বাধীন জনগণ যদি সশস্ত্র সংখ্যালঘু অথবা বাইরের শক্তির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করাই হবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এই ঘোষণাই• টুম্যান নীতি নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য ট্রুম্যান 'সশস্ত্র সংখ্যালঘু' বলতে সাম্যবাদী বিদ্রোহীদের এবং 'বাইরের শক্তি' বলতে সোভিয়েত রাশিয়াকে বুঝিয়েছিলেন।

পটভূমি: 

[1] চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত মিসৌরি প্রদেশের ফালটন শহরে এক বক্তৃতায় পূর্ব ইউরোপের রুশ প্রভাব বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে এক ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি সাম্যবাদের প্রসার রোধ করার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। 

[2] কেন্নানের বেষ্টনী নীতি: মার্কিন বিদেশনীতির উপদেষ্টা জর্জ, এফ. কেন্নান সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে এক প্রবন্ধ লিখে জানান, যুদ্ধে বিধ্বস্ত সোভিয়েত রাশিয়ার দিক থেকে কোনো আগ্রাসনের আশঙ্কা নেই। রুশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহেতুক কোনো যুদ্ধে না গিয়ে আমেরিকার উচিত হবে যে অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব রয়েছে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা। কেন্নানের এই নীতি টুম্যান নীতি ঘোষণায় উদ্‌বুদ্ধ করে।

উদ্দেশ্য: ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার আসল কয়েকটি লক্ষ্য ছিল— (1)রাজনৈতিক: যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত বা সাম্যবাদী প্রভাব প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধমূলক রণকৌশল গ্রহণ। (2) অর্থনৈতিক : ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল অর্থসাহায্যের নামে অন্যান্য দেশকে অস্ত্র ও শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রি করে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো।

গুরুত্ব : ট্রুম্যান নীতির ফলাফল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। —

[1] তুরস্ককে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা : ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে সোভিয়েত অস্তিত্ব প্রভাবমুক্ত করার জন্য কয়েকশত মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্যের কথা ঘোষণা করে। ফলে তুরস্ক তার স্বাধীন ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

[2] গ্রিসে কমিউনিস্ট তৎপরতা প্রশমন: রাশিয়ায় সাম্যবাদ থেকে দূরে থাকার পুরস্কাররূপে আমেরিকা গ্রিসের রাজতন্ত্রী সরকারকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ মঞ্জুর করে। গ্রিসে কমিউনিস্ট তৎপরতা প্রশমিত হয়। 

[3] ইরানের সঙ্গে চুক্তি : ইরানকে সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত করার জন্য আমেরিকা ইরানের সঙ্গে এক চুক্তি করে। এতে আসলে ইরানের তেলের খনিগুলি দখলের লক্ষ্যে আমেরিকা তাকে সামরিক ও বেসামরিক সাহায্য দেবে বলে।

[4] ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা : ট্রুম্যান নীতির ঘোষণা বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ঠান্ডা লড়াই- এর পরিবেশ তৈরি করে। এই ঘোষণার পর সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের সঙ্গে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটের 'ঠান্ডা লড়াই' শুরু হয়।


মার্শাল পরিকল্প

মূল বক্তব্য : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন) মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মার্শাল ইউরোপের সবকটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকেই মার্কিন অর্থসাহায্য গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ক্ষুধা-দারিদ্রা- বেকারত্বের জ্বালা নিবারণ করে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থসাহায্য করবে। তবে, সাহায্যপ্রার্থী দেশকে নিজের উদ্যোগে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর হতে হবে। আর ওই অর্থ সমাজতান্ত্রিক আদর্শানুযায়ী কোনো পরিকল্পনায় ব্যয় করা চলবে না। মার্শালের এই ঘোষণাই মার্শাল পরিকল্পনা বা মার্শাল এইড নামে খ্যাত।

পটভূমি : বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের সহায়তার নামে যে ঈমান নীতি ঘোষিত হয়, তাকে আরও সফলভাবে রূপায়ণ করার জন্য পেশ হয় মার্শাল পরিকল্পনা। 

উদ্দেশ্য: মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলি ছিল - (1) ইউরোপের মুখবিকার দেশগুলিকে অর্থসহায় দিয়ে তাদেরকে সোভিয়েত সাম্যবাদ থেকে মুক্ত করা। (2) অর্থসাহায্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলির অর্থনীতি মজবুত করে এক আন্তর্জাতিক বাজার গড়ে তোলা। (3) অর্থসাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলিকে মার্কিন নীতির প্রতি আস্থাশীল করে তুলে মার্কিন রাষ্ট্রজোটের শক্তি বাড়ানো । (4) অর্থসাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলির অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মার্কিন আধিপত্য কায়েম করা।

গুরুত্ব : মার্শাল পরিকল্পনার ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী-

[1] আর্থিক স্বয়ম্ভরতা বৃদ্ধিতে: ইউরোপের ১৭টি দেশ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে তিন বছরে সাড়ে বারোশো কোটি ডলার লাভ করে। এর মধ্যে অবশ্য কোনো কমিউনিস্ট দেশ ছিল না। এর ফলেই ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি আর্থিক স্বয়ম্ভরতা ফিরে পায়। ইউরোপে মোট শিল্পের উৎপাদন বেড়েছিল শতকরা ২৫ ভাগ এবং কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছিল শতকরা ১০ ভাগ।

[2] পুঁজিবাদী প্রবণতায় : গণতান্ত্রিক দেশগুলি সোভিয়েত সাম্যবাদ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বিশ্বে সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই দুই বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা ঘটে।

[3] কমিউনিস্ট দলের পরাজয়ে : ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলি নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলিকে পরাজিত করে।

[4] চেকোশ্লোভাকিয়াতে কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তনে : চেকোশ্লোভাকিয়াতে জোট সরকার মার্শাল পরিকল্পনার প্রতি আগ্রহ দেখালে স্টালিনের নির্দেশে সেখানে কমিউনিস্টরা জোর করে চেক সরকারের উচ্ছেদ ঘটিয়ে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম করে। 

উপসংহার : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মানসিকতা বিশ্বরাজনীতিকে এক জটিল আবর্তে নিক্ষেপ করে। তবুও মার্শাল পরিকল্পনা ও ট্রুম্যান নীতি তার উদ্দেশ্যপূরণে অনেকটা সফল হয়েছিল বলা চলে। এ প্রসঙ্গে ফ্রিডম্যান বলেছেন—১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের জুনে যখন মার্শাল প্ল্যান কর্মসূচির অবসান ঘটলো ততদিনে তা প্রত্যাশা মতোই সাফল্য অর্জন করেছে



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন