সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্তাবলি উল্লেখ করো। এই চুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

লক্ষ্ণৌ চুক্তি

জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশন চলাকালীন চরমপন্থী নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেস ও মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার নাম ‘লাক্ষ্ণৌ চুক্তি’। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যেকার যাবতী বিভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (১৯১৬ খ্রি.) । ঐতিহাসিক বিধানচন্দ্র তার 'Modern India' গ্রন্থে লিখেছেন- হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ক্ষেত্রে লক্ষৌ চুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপরূপে চিহ্নিত।

লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্তাবলি: লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মিলিতভাবে সরকারের কাছে কিছু দাবি পেশ করে। এই সমস্ত দাবিগুলিতে বিকেন্দ্রীকরণ, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ও ভারতীয়করণের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। চুক্তির অন্যতম কিছু শর্ত ছিল—

(a) কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন হবে। যার মধ্যে চার- পঞ্চমাংশ হবে নির্বাচিত সদস্য এবং এক-পঞ্চমাংশ হবে মনোনীত সদস্য। যতটা সম্ভব ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচিত হবে। নির্বাচিত সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম সদস্য, যাঁরা মুসলমানদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন।

(b) প্রাদেশিক আইনসভায় প্রদেশের ক্ষেত্রে সদস্য হবে কমপক্ষে ১২৫ জন। ছোটো প্রদেশের ক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা হবে ৫০ থেকে ৭৫ জনের মধ্যে। এক্ষেত্রে প্রদেশগুলির চার-পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন নির্বাচিত সদস্য এবং বাকি এক-পঞ্চমাংশ হবেন মনোনীত সদস্য।

(c) এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব থাকে। বিশেষ নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে প্রাদেশিক আইনসভায় নিম্নলিখিত সংখ্যানুপাতে মুসলিম প্রতিনিধি রাখতে হবে।

পাঞ্জাব—মোট নির্বাচিত সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ

যুক্তপ্রদেশ—মোট নির্বাচিত সদস্যদের ৩০ শতাংশ 

বাংলা—মোট নির্বাচিত সদস্যদের ৪০ শতাংশ    

বিহার—মোট নির্বাচিত সদস্যদের ২৫ শতাংশ

মধ্যপ্রদেশ (C.P.)—মোট নির্বাচিত সদস্যদের ১৫ শতাংশ মাদ্রাজ—মোট নির্বাচিত সদস্যদের ১৫ শতাংশ

বোম্বাই—মোট নির্বাচিত সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ

এইসব সংরক্ষিত আসনগুলি ছাড়া মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্য কোনো আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। 

(d) কেন্দ্রের হাতে থাকবে বৈদেশিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাগগুলি। এগুলি ছাড়াও শুল্ক, রেল, ডাক ও তার সংক্রান্ত বিভাগ থাকবে কেন্দ্রের হাতে।

(e) ভারত-সচিবের পরিষদের বিলোপ ঘটাতে হবে। ব্রিটিশ সরকার ভারত সচিবকে বেতন দেবেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য দুজন সহকারী থাকবেন, যাদের একজন হবেন ভারতীয়।

(f) আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত প্রস্তাবসমূহ সরকারকে মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে গভর্নর ভেটো দিতে পারবেন। 

(g) সামরিক বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ করতে হবে।

(h) ব্রিটিশদের অন্যান্য ডোমিনিয়ন যে মর্যাদা ও প্রতিনিধিত্ব পায় তা ভারতকেও দিতে হবে। 

লক্ষ্ণৌ চুক্তির গুরুত্ব:

নানা ধরনের বিরূপ সমালোচনা থাকলেও তৎকালীন ভারতের রাজনীতিতে লক্ষ্ণৌ চুক্তির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

(a) লিগ-কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতা: লিগের তরফে জিন্না এবং কংগ্রেসের তরফে বালগঙ্গাধর তিলক ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই চুক্তিকে স্বাগত জানান | লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে লিগ ও কংগ্রেস নিজেদের তিক্ততা ভুলে পুনরায় মিলিত হয়। তারা মিলিতভাবে ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

(b) হিন্দু-মুসলিম মনিষ্ঠ: লক্ষ্ণৌ চুক্তির মধ্যে দিয়ে হিন্দু- পুনরায় উভয়ের কাছাকাছি আসে। এই চুক্তি প্রমাণ করে দেয় ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও জাতীয় প্রয়োজনে দুই সম্প্রদায়ের মিলন সম্ভব। সুরেন্দ্রনাথ বলেন যে, "হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভাবগত ঐক্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এই চুক্তি।"

(c) জনমানসে উদ্দীপনা: লক্ষ্ণৌ চুক্তির মধ্যে একদিকে যেমন কংগ্রেস ও লিগের মিলন ঘটে, অপরদিকে তেমনই নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের নেতৃবর্গের মধ্যে এক ঐক্যের সুর ধরা পড়ে। নরমপন্থী নেতৃবর্গের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ এবং চরমপন্থী নেতৃবর্গের মধ্যে তিলক এই চুক্তিতে সমর্থন করেন। এর ফলস্বরূপ সার্বিকভাবে জনমানসে এক রাজনৈতিক উদ্দীপনা তৈরি হয়।

(d) ব্রিটিশ সরকারের অর্থপ্তি: কংগ্রেসের একতা, বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতি, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং অ্যানি বেসান্তের হোমরুল লিগ আন্দোলনের ধাক্কায় এমনিতেই ব্রিটিশ সরকার বিপর্যন্ত ছিল। তার ওপর লক্ষ্ণৌ চুক্তির মধ্য দিয়ে কংগ্রেস ও লিগের ঘনিষ্ঠতা এবং হিন্দু- মুসলিম ঐক্য সরকারকে এক চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে। এতদিন ধরে সরকার দমনপীড়ন ছাড়াও (হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে) বিভেদ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনে অভ্যন্ত ছিল। কিন্তু লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্রিটিশের সেই বিভেদনীতির অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা ও অকেজো হয়ে যায়।

(e) স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ঘোষণা: লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতীয়তাবাদী জনমতকে ব্রিটিশের পক্ষে আনার লক্ষ্যে ভারত-সচিব মন্টেগু এক ঘোষণা করেন (২০ আগস্ট, ১৯৯৭ খ্রি.)। এই ঘোষণায় তিনি বলেন যে, ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে স্বায়ত্তশাসন দানই হল ব্রিটিশ সরকারের নীতি। এই ঘোষণার ফলশ্রুতি হিসেবে পরবর্তীকালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কার আইন পাস হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...