সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পেশাদারি ইতিহাস বলতে কী বোঝায় ? অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য কী ?

পেশাদারি ইতিহাস

ইতিহাস হল আসলে মানবস্মৃতির অতীত কর্মকাণ্ডের কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিক লিখিত বিবরণ। এই ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদেরকে ইতিহাসবিদ বা ঐতিহাসিক বলা হয়। এই ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকে ইতিহাস চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন, যারা পেশাদার ঐতিহাসিক নামে পরিচিতি পান। আবার ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ অবসর হিসেবে শখের ইতিহাস চর্চা করে থাকেন, যারা হলেন মূলত অপেশাদারি ঐতিহাসিক। বর্তমানকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাদারি ভিত্তিতে নানা ধরনের ঐতিহাসিক গবেষণার কাজ হয়ে চলেছে। গবেষণা থেকে বর্তমানকালে প্রতিনিয়ত ইতিহাসের নতুন নতুন দিকের উন্মোচন হয়ে চলেছে। এগুলি পেশাদারি ইতিহাস চর্চার অন্যতম উদাহরণ। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারি ইতিহাস চর্চার ধারাও প্রচলিত রয়েছে।

পেশাদারি ও অপেশাদারি ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য

(1) উদ্ভব

প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউরোপের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিহাস চর্চার কাজ পেশাদারি ভিত্তিতে শুরু হয়। সেই সময় থেকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বা ঐতিহাসিক গোষ্ঠী ইতিহাস চর্চা ও ইতিহাসের গবেষণাকে পেশাদারি কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং পেশাদারি ভিত্তিতেই ইতিহাসের নতুন নতুন দিকের উন্মোচন করে চলেছেন।

কিন্তু, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চা উনিশ শতকের অনেক আগেই অর্থাৎ প্রাচীন কাল থেকেই শুরু হয়েছে বলা যায়। গ্রিক  ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস, থুকিডিডিস যে ইতিহাস চর্চার সূচনা ঘটান তাতে পেশাদারিত্বের ছাপ ছিল না। তাঁরা মূলত পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জাতীয় ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য | কলম ধরেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহাসিক কলহনের কথাও উল্লেখ করা যায়।

(2) আর্থিক সম্পর্ক

পেশাদারি ইতিহাস চর্চায় আর্থিক সম্পর্কের বিষয়টি ছড়িয়ে থাকে। পেশাদারি ইতিহাস চর্চার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা মেলে। পাশাপাশি এই ধরনের ইতিহাস চর্চায়  ইতিহাসবিদ ব্যক্তিগতভাবে ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পান। পেশাদারি ইতিহাসবিদদের জীবন-জীবিকাও অনেকাংশে নির্ভরশীল তাদের এই ইতিহাস চর্চার কাজের ওপর।

কিন্তু, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সাধারণত সরকারি আর্থিক সহায়তা মেলে না। ইতিহাসবিদ বা গবেষকগণ নিজের আর্থিক ব্যয়ে ইতিহাস চর্চা বা গবেষণার কাজ করে থাকেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সুবিধা লাভের তেমন সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে ইতিহাস চর্চা জীবন-জীবিকাও তেমনভাবে সাহায্য করে না বলা চলে।

(3) পদ্ধতি 

পেশাদারি ইতিহাসবিদগণ তাদের গবেষণার কাজে খুব উন্নত মানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।

কিন্তু, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চায় সাধারণত স্থানীয় তথ্যাদি, ক্ষেত্রসমীক্ষা প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করে ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়।

(4) সময়

পেশাদারি ইতিহাস চর্চা হল একটি সর্বক্ষণের কাজ। গবেষক বা ইতিহাসবিদগণ তাদের প্রধান পেশা হিসেবে ইতিহাস চর্চার কাজ করে থাকেন।

কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপেশাদারি ইতিহাস চর্চায় গবেষকগণ তাদের ইতিহাস চর্চার কাজটিকে একটি আংশিক সময়ের কাজ হিসেবে গণ্য করে থাকেন।

(5) ব্যাপ্তি

বর্তমানকালে অধিকাংশ বড়ো ধরনের প্রেক্ষাপটে ইতিহাস চর্চা পেশাদারি ইতিহাসবিদগণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এই জাতি বা রাষ্ট্রের এমনকি সভ্যতার উত্থান, পতন, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতিসহ বিভিন্ন দিকগুলির ওপর আলোকপাত করা হয়।

কিন্তু, বর্তমানকালে অপেশাদারি ইতিহাস চর্চা তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেসমস্ত স্থানীয় ইতিহাস চর্চাগুলি হয়ে থাকে সেগুলি স্থানীয় ইতিহাসকে তুলে ধরে।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...