সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। এই মামলাটির পরিণতি কী হয়েছিল?

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা

কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ ও তাদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩২ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এটি ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।


মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট

সূচনা: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা জন্মলগ্ন থেকেই কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা এই দুই শ্রেণিকে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারায় শামিল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভারত সরকারের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় — শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সাম্যবাদী আদর্শের প্রচার ও প্রভাব সরকারের পক্ষে গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট গুলি নিচে উল্লেখ করা হলো –

[1] শ্রমিক আন্দোলন: ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আন্দোলনে সরব হলে ভারতের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্র ও বাক্-স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা প্রভৃতি দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিক | আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রসারে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

[2] হুইটলি কমিশন: শ্রমিকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি ও আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের ক্ষোভ ও আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হুইটলি কমিশন’ (Whitley Commission) গঠন করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে।

[3] শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন: বড়োলাট লর্ড আরউইন 'শিল্পবিরোধ বিল' (Trade Disputes Bill) ও 'জননিরাপত্তা বিল' ( Public Safety Bill) নামে শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী দুটি আইন পাসের উদ্যোগ নেন। শিল্পবিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক বিরোধের মীমাংসার কথা বলা হয়। জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

[4] মামলা: কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ ও শ্রমিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভাঙ্গে-সহ ৩২ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এটি ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিত। অভিযুক্ত ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। এঁরা হলেন ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি এবং লেস্টার হাচিনসন।


মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন জওহরলাল নেহরু, এম. সি. চাগলা প্রমুখ। মামলার পরিণতি কমিউনিস্টদের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি, যেমন—

[1] মামলার রায়: ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড প্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, কে. এন. জোগেলকর, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী, ফিলিপ স্প্যাট প্রমুখ।

[2] গান্ধিজির ভূমিকা: কংগ্রেস নেতা গান্ধিজি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষ সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।

[3] অন্যান্য পদক্ষেপ: ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসার, শ্রমিক ইউনিয়নগুলির সক্রিয়তা, শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতি স্তব্ধ করতে সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

[4] পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা : বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাদের কারাদণ্ড সত্ত্বেও ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কমিউনিস্ট দলের প্রভাবে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব লক্ষ করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে (২৩ জুলাই) কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।

[5] বামপন্থী আদর্শের প্রসারে পরোক্ষ সহায়তা: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে বামপন্থার প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছোলে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।

উপসংহার: শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে সরকার শিল্প বিরোধ বিল, জন নিরাপত্তা বিল ইত্যাদি শ্রমিক স্বার্থ-‌ মুজাফফর আহমেদ বিরোধী আইন প্রণয়ন করে। ওই দমননীতিরই একটি প্রয়াস হিসেবে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় দলিল হয়ে আছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাকে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সরকারের আক্রমণাত্মক নীতি বলে উল্লেখ করেন।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...