সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জেনেভা সম্মেলন– ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ । পটভূমি, শর্তাবলি, ফলাফল ও গুরুত্ব

সূচনা: দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনায় ফরাসিদের ব্যর্থতার পর জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (১৯৫৪ খ্রি., ৮ মে)। ইন্দোচিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী পিয়ের মেন্ডেস ফ্রাঁস জেনেভা সম্মেলন আহবান করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে জেনেভা সম্মেলনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও অবশেষে জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলিকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় বলা হয়, সম্মেলন স্বীকার করে যে, ভিয়েতনাম সম্পর্কিত চুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য হল যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য সামরিক প্রশ্নের একটা মীমাংসা করা।


জেনেভা সম্মেলন– ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ । পটভূমি, শর্তাবলি, ফলাফল ও গুরুত্ব


সম্মেলনের পটভূমি: উত্তর ভিয়েতনামে দিয়েন-বিয়েন-ফু (১৯৫৪ খ্রি.)-র শোচনীয় ব্যর্থতার পর ফ্রান্স আর ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালাতে রাজি ছিল না। তার রাজি না হওয়ার পেছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল। সেগুলি হল— (1)মান- সম্মান বজায় থাকতে থাকতেই ফ্রান্স নিজেকে ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। (2) ইতিপূর্বেই জাতীয় নির্বাচনে ফ্রান্সে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়ে গেছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের মেন্ডেস ফ্রাঁস ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। তিনি চেয়েছিলেন ইন্দোচিন সমস্যার সমাধান আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হোক। আর এ ব্যাপারে তিনি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই রকম এক প্রেক্ষাপটে কালবিলম্ব না করে দিয়েন-বিয়েন-ফু-তে ফরাসি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিনই (৮ মে, ১৯৫৪ খ্রি.) জেনেভায় ইন্দোচিন সমস্যার সমাধানকল্পে একটি সম্মেলন বসে। এটিই জেনেভা সম্মেলন (১৯৫৪ খ্রি.) নামে পরিচিত। ইন্দোচিন সমস্যার সমাধানকল্পে আহূত জেনেভা সম্মেলনে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন, ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্বোডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যোগদান করেন। অবশেষে ২০ জুলাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়।

জেনেভা চুক্তির শর্তাবলি: জেনেভা চুক্তির শর্তগুলি ছিল—(1) ১৭° অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে দু- ভাগে ভাগ করা হবে। (2) ওই অক্ষরেখার উত্তরাঞ্চলে ভিয়েতমিন এবং দক্ষিণাঞ্চলে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েম- এর শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে। (3) উত্তর বা দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোথাও কোনো বিদেশি সেনা থাকবে না। (4) ভিয়েতনামের ওই বিভাজন হবে সম্পূর্ণ সাময়িক। শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুই ভিয়েতনামের মিলনের জন্য একটি নির্বাচন আহ্বান করা হবে। (5) ওই নির্বাচন জাতিপুঞ্জ গঠিত একটি তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে দু-বছর পরে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হবে। প্রসঙ্গত, ওই নির্বাচন তদারকির জন্য ভারতের নেতৃত্বে পোল্যান্ড ও কানাডাকে নিয়ে কমিশনটি গঠিত হয়। (6) দুই ভিয়েতনামকে ঐক্যবন্ধের লক্ষ্যে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোপন ব্যালটে গণভোট নেওয়া হবে। (7) জেনেভা সম্মেলনে যুগ্ম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। (৪) লাওস ও কাম্বোডিয়া থেকে ফরাসি ও ভিয়েতমিন সেনা অপসারিত হবে এবং ওই দুই দেশে ফরাসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে পূর্বতন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। (9) কাম্বোডিয়া, লাওস, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকার কোনোরকম সামরিক জোটে আবদ্ধ হবে না। (10) ইন্দোচিনে কোনো বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। (11) যুদ্ধবিরতি তদারকের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠিত হবে।

জেনেভা চুক্তির ফলাফল: জেনেভা চুক্তি (১৯৫৪ খ্রি.) দ্বারা ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান হয়নি। এই ব্যর্থতার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। সেগুলি হল- 

  1. নব অধ্যায়ের সূচনায়: এই সম্মেলন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালেও, আর একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সম্মেলনে ভিয়েতনামকে দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়। ফলে ঐক্যবদ্ধতার প্রশ্নে ভিয়েতনামে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।  
  2. সংকটের স্থায়িত্ব: জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ফরাসি শক্তি সরে গেলেও তার জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করে। ফলে ভিয়েতনাম সংকট সমস্যাগ্রস্ত হয়েই থাকে।  
  3. ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু: স্টালিনসহ সোভিয়েত রাজনীতিবিদরা মনে করেছিলেন নিরপেক্ষ বলয়রূপে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সামরিক জোটের বাইরে রাখা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ভিয়েতনাম ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। 
  4. নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিরোধ: সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাষ্ট্রসংঘের তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামে নির্বাচনের ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের অসহযোগিতায় বানচাল হয়ে যায়। ফলে জেনেভা সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়।

জেনেভা সম্মেলনের গুরুত্ব: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জেনেভা সম্মেলন ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ-  

  1. নিরপেক্ষ ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগ্রহণ: জেনেভা সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী ভিয়েতনামে শান্তিপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এক নিরপেক্ষ ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল।  
  2. শান্তিপ্রতিষ্ঠা: বিশ্ব জুড়ে যখন ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধোন্মাদনার হাতছানি দেখা যাচ্ছে তখন শান্তিপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চিন, ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ভিয়েতনামে শান্তিপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একজোট হচ্ছেন; এটাই সেসময়কার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক প্রশংসনীয় পদক্ষেপ বলা চলে।  
  3. তৃতীয় বিশ্বের উত্থান: এই সম্মেলনে যেভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তা পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের উত্থানের পথকে প্রশস্ত করেছিল।  
  4. সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি: জেনেভা সম্মেলনে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম দীর্ঘ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হয়। এর পাশাপাশি লাওস ও কাম্বোডিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায়।

উপসংহার: জেনেভা সম্মেলন কেবলমাত্র ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধানের পদক্ষেপ নয়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরদানের প্রচেষ্টাও বটে। জেনেভা চুক্তির পরবর্তী সময়কালে ভিয়েতনামে শান্তিপ্রতিষ্ঠার বদলে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। মুখে শান্তিপ্রতিষ্ঠার কথা বললেও এখানে আমেরিকা তার সামরিক কর্মসূচি বজায় রাখে। এই চুক্তি থেকে ভিয়েতনামবাসীরা কোনো সুফল পায়নি। এতদিন ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রক্ত ঝরানোর পর এবার তাদের মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...