আবুল ফজল
ভারতবর্ষে মুসলমান শক্তির উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রবণতার সৃষ্টি করেছিল, তেমনি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও নতুন এক যুগ বহন করে এনেছিল। মোগল যুগের ইতিহাসচর্চা বিশেষ করে দরবারী ইতিহাসের শ্রেষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন আবুল ফজল। আকবরের মন্ত্রী, বন্ধু, রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিবিদ ও সামরিক অফিসার আবুল ফজল ইতিহাস রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শৈশবেই তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে ছিলেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের সমস্ত শাখায় দক্ষতা লাভ করেন। নির্যাতিত ও অত্যাচারিত পরিবারের দুর্ভাগ্য আবুল ফজলের চিন্তার উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। মোগল সম্রাট আকবরের আশ্রয় ও পৃষ্টপোষকতা লাভ করার পর তিনি রচনা করেন দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ-‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’।
মধ্যযুগের ভারতের ঐতিহাসিকদের মধ্যে আবুল ফজল ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান।‘আকবরনামা’-র দ্বিতীয় খন্ডে তিনি ইতিহাস ও ইতিহাস তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর মতামত রেখেছেন। পূর্বসূরীদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘এদের কাছে ইতিহাস হল মুসলমানদের ভারত জয়, শাসন এবং হিন্দু-মুসলমান বিরোধ।’ কিন্তু আবুল ফজলের কাছে ইতিহাস ছিল জ্ঞানদীপ্তির উৎস, যুক্তিবাদের প্রসারের সহায়ক জ্ঞান। তাঁর ইতিহাস দর্শনের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত হয়েছে ইতিহাস পদ্ধতি। তিনি জানতেন, খুব যত্ন করে অনুসন্ধান চালিয়ে উপাদান সংগ্রহ করতে হয়। যুক্তি ও তথ্যের অভাব হলে ইতিহাস হবে গল্প-কাহিনী, প্রকৃত ইতিহাস নয়।
এমনকি ইতিহাস ও দর্শনের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক আছে বলে আবুল ফজল মনে করতেন। আবুল ফজল হলেন মধ্যযুগের একমাত্র ঐতিহাসিক, যিনি বহুমাত্রিক ইতিহাস রচনা-পদ্ধতির কথা বলেছেন। একটিমাত্র উপাদান সংগ্রহ নয়, মূল আকর সংগ্রহের উপর তিনি জোর দিয়েছেন। বিভিন্ন উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করে তিনি ইতিহাস লেখার পক্ষপাতি ছিলেন। প্রতিবেদন, স্মারক লিপি, বাদশাহী ফরমান এবং অন্যান্য তথ্য তিনি সযত্নে ব্যবহার করেছেন। আকবরের সাম্রাজ্যিক ধারণা, শাসনব্যবস্থা, জনকল্যাণকামী নীতি ও ধর্মীয় সহিষঞ্চুতার তিনি ছিলেন উৎসাহী সমর্থক। এজন্য তাঁর রচনা হয়েছে কিছুটা পক্ষ পাতিত্বপূর্ণ ও আকবরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি সমকালীন ইতিহাসের তথ্য-পূর্ণ বিবরণ রেখেছেন। অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে হিন্দুদের ধর্ম, দর্শন, সামাজিক আচারণ ইত্যাদি অনুধাবণের চেষ্টা করেছেন।
এই মহান ঐতিহাসিকের মূল্যায়নে তাঁর অপূর্ণতার কথাও উল্লেখ করতে হয়। অনেক পরিশ্রম করে তিনি আকবরের শাসনকালের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য সরবরাহ করেছেন। কিন্তু বর্ণনা দেবার সময় তিনি মন্ময়চিত্ত বস্তু জগতের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেননি। শাসনের বাস্তব চিত্র তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না, ঘটনা ও চরিত্রের উপর তিনি নিজস্ব মতামত চাপিয়েছেন। আবুল ফজল প্রথা ও ঐতিহ্য নয়, যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ বীরনায়ক আকবরকে তিনি এই মাপকাঠিতে বিচার করেননি। আকবরের দূর্বলতাকে তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। আবার আকবরের ইবাদৎখানা, ধর্মচিন্তা, উলেমাদের সঙ্গে বিরোধ ইত্যাদির যে বিবরণ তিনি দেয়েছেন, সেটাও সত্য ও সম্পূর্ন নয়। এই কারণে তাঁর মতামতকে নিরপেক্ষ ও তথ্য নির্ভর বলে গ্রহণ করা যায় না।
আরও অনেক ক্ষেত্রে আবুল ফজল ঐতিহাসিকের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেননি। তিনি শেরশাহের কৃতিত্বকে লঘু করে দেখিয়েছেন। এখানে ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষতা অবশ্যই ক্ষুন্ন হয়েছে। বস্তুত আবুল ফজল আকবরকে নিয়ে এতই ব্যস্থ ছিলেন যে অনেক কিছুই বাদ দিয়েছেন। সমসাময়িক রাজপুত, আফগান ও মোগলদের মধ্যে যে ত্রিপক্ষিয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল সে বিষয়ে আবুল ফজল নিরব থেকেছেন। একইভাবে রাজসভার বাইরের জীবনের কোন বর্ণনা তাঁর বিবরণে নেই। আসল কথা তাঁর শিক্ষা ও মনন এমন ছিল যে তিনি সাধারণ ও অগভীর বিষয়ে দৃষ্টি দিতে পারেননি। এই কারণে তাঁর ইতিহাস হয়েছে একপেশে ও অসম্পূর্ণ।
এইভাবে আমরা দেখতে পারি, আবুল ফজল নিরপেক্ষ ভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের চিত্র তুলে ধরতে পারেননি। তিনি এই কারণে বদাউনি (আরও পড়ুন), বারনী, নিজামুদ্দিন বা ফেরিস্তার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছেন। এসব স্বীকার করেও আমরা বলতে পারি তিনি একেবারেই ব্যর্থ নন। তিনি বহুমাত্রিক ইতিহাসচর্চার প্রবর্তন করেন, যা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের দাবী করতে পারে। ইতিহাসের বিষয়বস্তুর বিস্তার তাঁর হাত ধরেই সম্ভব হয়েছিল। প্রদেশগুলির প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রশাসনিক নিয়ম ইত্যাদির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তাই বলা যায়, ঐতিহাসিক হিসাবে আবুল ফজলের অবদান কোনভাবেই নগন্য নয়, বরং স্থায়ী ও চিত্তাকর্ষক।