সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো।

সূচনা: ভারতের বড়োলাট লর্ড ডালহৌসির আমলে 'গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি' (GIPR) ভারতে সর্বপ্রথম রেলপথের প্রতিষ্ঠা করে। ডালহৌসিকে ভারতীয় রেলপথের জনক বলা হয়। তাঁর আমলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ এপ্রিল) বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল রেলপথ স্থাপিত হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্বভারতের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ভারতের দ্বিতীয় রেলপথ চালু হয়। ডালহৌসির আমলে ভারতের প্রায় ২০০ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলপথের জাতীয়করণ করা হয় ও এটি বিশ্বের বৃহত্তম নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম রেলপথ স্থাপন করেন।

রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য বা কারণ


[1] ডালহৌসির উদ্দেশ্য: লর্ড ডালহৌসি বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যগুলি হল— [i] ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানো। [ii] রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। [iii] দেশে শিল্প পরিকাঠামো গড়ে তুলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো। [iv] দেশের কাঁচামাল বন্দরগুলিতে পৌঁছোনো। [v] উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী সহজে দেশের ব্রিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি।

[2] পুঁজি বিনিয়োগ : শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শিল্পপতিরা বিপুল পরিমাণ পুঁজির মালিক হয়ে ওঠে। তারা এই বিপুল পরিমাণ পুঁজি ভারতের নিরাপদ, লাভজনক ও সুবিধাজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে আরও পুঁজি উপার্জন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতে রেলপথ নির্মাণে মূলধন বিনিয়োগ করা তাদের কাছে যথেষ্ট নিরাপদ ও লাভজনক বলে মনে হয় ।

[3] কাঁচামাল রপ্তানি : ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে সেখানকার কলকারখানাগুলিতে কাঁচামালের চাহিদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ভারত হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে কাঁচামালের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি থেকে কাঁচামাল বন্দরে পৌঁছোনে জন্য রেলযোগাযোগের প্রয়োজন দেখা দেয়।

[4] বিলাতি পণ্যের সরবরাহ: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে সেখানকার কলকারখানাগুলিতে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এই পণ্য বিক্রির বাজার হিসেবে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারতের অভ্যন্তর দূরদূরান্তের বাজারগুলিতে এই পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা এদেশে উন্নত রেলযোগাযোগের প্রয়োজন উপলব্ধি করে।

[5] রাজনৈতিক প্রয়োজন: ডালহৌসির আমলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে দ্রুত যোগাযোগ রক্ষা ও সংবাদ আদানপ্রদানের প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়াও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য ও রসদ পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের তাগিদে সেই সময় ভারতে রেলপথ স্থাপন অপরিহার্য বলে ব্রিটিশ সরকার মনে করে।

[6] সামরিক প্রয়োজন : বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল না, এমন বহু স্থানেও শুধু সামরিক প্রয়োজনে রেলপথ স্থাপিত হয়।

[7] দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্ভিক্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের মানুষের কাছে দ্রুত খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার এদেশে রেলপথ স্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করে।

[8] কর্মসংস্থান: সরকার আশা করে যে, ভারতে রেলপথ স্থাপিত হলে এখানে বহু ইংরেজের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে ও ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের অর্থ লগ্নির যথেষ্ট সুযোগ হবে।

ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের প্রভাব

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা এদেশের অর্থনীতিকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের সুবিস্তৃত অঞ্চলে রেলপথের প্রসার ঘটে। ভারতের‌ ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের কিছু সুফলও লক্ষ করা যায়। ড. বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, “ভারতে রেলপথের প্রবর্তন ভারতীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে।” দাদাভাই নওরোজি, জি. ভি. যোশি, ডি. ই. ওয়াচা, জি. এস. আয়ার, রমেশচন্দ্র দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা এদেশে রেলপথ নির্মাণের বহু কুফল লক্ষ করেছেন।

সদর্থক প্রভাব 

[1] যোগাযোগের প্রসার: ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে। ওঠে এবং সরকারি কাজে গতি বৃদ্ধি পায়।

[2] পরিবহণের উন্নতি : রেলপথ স্থাপনের আগে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত ছিল। রেলপথ স্থাপনের পর এর মাধ্যমে ভারতের মানুষ ও পণ্য পরিবহণে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। অতি দ্রুত মানুষ ও পণ্য চলাচল সম্ভব হওয়ায় দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় দূরদূরান্তে খাদ্য পাঠানো সহজ হয়।

[3] আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: রেলপথের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হলে তাদের মধ্যে পণ্য চলাচল সম্ভব হয়। ফলে পণ্যমূল্যের আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

[4] রপ্তানি বৃদ্ধি : রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণের ব্যয় খুব কম হত। ফলে ভারতের বিভিন্ন কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে সহজে বন্দরে নিয়ে যাওয়া যেত। বন্দরগুলি থেকে ভারতের পণ্যসামগ্রী সহজে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ১৮৬২ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় ২১/২ গুণ বৃদ্ধি পায়।।

[5] আমদানি বৃদ্ধি: রেলের মাধ্যমে ভারতে বিদেশি পণ্যের আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিলাতের বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও বিলাস-সামগ্রী ভারতের বন্দরে এসে তা রেলের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে যায়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে আমদানির পরিমাণ ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।

[6] আন্তর্জাতিক বাজার: আগে আঞ্চলিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভারতে কৃষি-উৎপাদন চলত। রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতের কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে বন্দরে পৌঁছে সহজেই আন্তর্জাতিক বাজারে যাওয়ার সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি মূল্য পাওয়া যায় এমন কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

[7] শিল্পায়ন: কার্ল মার্কস বলেছেন যে, রেল ব্যবস্থা ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে। বাস্তবক্ষেত্রেও রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতে শিল্পের বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়। রেল ব্যবস্থা স্বল্পব্যয়ে কাঁচামালের জোগান দিয়ে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে লোহা, ইস্পাত, কয়লা প্রভৃতি আধুনিক শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে।

[৪] কর্মসংস্থান: ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে রেলপথ নির্মাণ, রেল কারখানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। দেশের ভূমিহীন কৃষকরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রেলের কাজে নিযুক্ত হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলে নিযুক্ত মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৭৩ হাজার।

[9] জাতীয় ঐক্য : রেলপথের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পায়।

নঞর্থক প্রভাব 

[1] বৈষম্যমূলক আচরণ: ভারতীয় যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা ভারতীয় যাত্রীদের লাঞ্ছনা করত। মালপত্র পরিবহণে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ভারতীয়দের বেশি ভাড়া দিতে হত।

[2] সম্পদের বহির্গমন: প্রথম পর্বে রেলপথ নির্মাণে যে বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিযোগ করা হয়, গ্যারান্টিপ্রথার মাধ্যমে সরকার তাতে বার্ষিক ৫ শতাংশ সুদ দেওয়ার গ্যারান্টি দেয়। এর ফলে প্রতি বছর সুদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও লাভের মুনাফা বিদেশে চলে যেতে থাকে।

[3] দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়: বিলাতের কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রেলের মাধ্যমে ভারতের বাজারগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। দেশীয় পণ্যগুলি সস্তা ও সুদৃশ্য বিলাতি পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। ফলে দেশীয় কুটিরশিল্প ও বাণিজ্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

[4] যন্ত্রপাতি আমদানি: ভারতে রেলপথ স্থাপনের জন্য রেলের ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিগুলি ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আনা হত। ফলে ভারতে রেলপথ নির্মিত হলেও এদেশে ভারী শিল্পের বিশেষ প্রসার ঘটেনি।

[5] কর্মসংস্থানে বর্ণনা: ভারতে রেলপথের সম্প্রসারণের ফলে রেলের কাজে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। কিন্তু এর উচ্চপদগুলিতে সাধারণত শ্বেতাঙ্গদের নিযুক্ত করা হত। নিম্ন বেতনের শ্রমসাধ্য কাজগুলিতে ভারতীয় অদক্ষ শ্রমিকরা নিযুক্ত হত।

[6] দুর্ভিক্ষের প্রকোপ: দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে রেলের মাধ্যমে খাদ্য পাঠানো সহজতর হলেও পরোক্ষে এই রেল ব্যবস্থাই আবার দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে।

[7] জলপথ ও সেচের ক্ষতি: দেশের সুবিস্তৃত অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের জন্য বিভিন্ন নিম্নভূমিতে মাটির বাঁধ দিয়ে রেলপথ এবং নদীনালার ওপর রেলের সেতু তৈরি করতে হয়। ফলে জলস্রোত বন্ধ হত। এসব কারণে কৃষিজমিতে সেচের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

[৪] শাসনের আধিপত্য বৃদ্ধি : রেলপথের শিকড় ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ শাসনের আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পায়। দেশের যে-কোনো প্রান্তে ব্রিটিশবিরোধী অসন্তোষ বা বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দিলে সরকারের পুলিশ ও সেনা অতি দ্রুত সেই উপদ্রুত অঞ্চলে পৌঁছে দিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয়।

উপসংহার: রেলপথের প্রসারের ফলে ঔপনিবেশিক ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক উপাদান যুক্ত হয়। এর দ্বারা দরিদ্র ভারতীয়রা সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে রেলপথ স্থাপনের কিছু সুফল অবশ্যই ছিল। রেলের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটেছিল তার সুফল থেকে ভারতীয়রা বঞ্চিত হয়নি।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

খুত ও মুকদ্দম কাদের বলা হত? কে, কেন তাদের কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করেন ?

খুত ও মুকদ্দম         বাজার দর নিয়ন্ত্রণ এবং জীবন নির্বাহের ব্যয় হ্রাস করেই আলাউদ্দিন খলজি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য সচেষ্টও হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। রাষ্ট্রের অধীনে খাদ্য ও জমি বৃদ্ধির জন্য তিনি সর্বপ্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর অবলম্বন করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায় ও ধার্মিক ব্যক্তিদের মিলক্, ইনাম, ইদ্দ্ররাৎ এবং ওয়াকফ জমি রাষ্ট্রের অধীনে পুনরায় আনয়নের চেষ্টা করেন। মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়র ও ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরই সুলতান অলাউদ্দিন খলজি খুত, চৌধুরী ও মুকদ্দম নামে পরিচিত হিন্দু অভিজাতবর্গের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। “খুত” শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও সম্ভবত পরবর্তীকালে যার জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করেন আলাউদ্দিনের-রাজত্বকালে তাঁরা খুত নামে পরিচিত ছিলেন। “চৌধুরী” ছিলেন পরগণার প্রধান ব্যক্তি এবং “মুকদ্দম” ছিলেন গ্রামের প্রধান। রাষ্ট্রের প্...