রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল? গান্ধিজি কেন এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন

রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য এবং রাওলাট আইনের বিরোধিতা ও গান্ধিজি


উদ্দেশ্য: 

  • শ্বেতাঙ্গদের খুশি করার চেষ্টা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু- চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের মাধ্যমে সরকার ভারতীয়দের কিছুটা তোষণ ও তাদের কিছু কিছু স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাসম্পন্ন কিছু কিছু ইংরেজ অসন্তুষ্ট হয় । এই শ্রেণিকে খুশি করার উদ্দেশ্যে সরকার ভারতীয়দের ওপর তীব্র দমনমূলক আইন চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
  • ভারতরক্ষা আইন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশবিরোধী সব ধরনের আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার 'ভারতরক্ষা আইন' (Defence of India Act, 1915 ) নামে একটি দমনমূলক আইন প্রবর্তন করেছিল। যুদ্ধ শেষে এই আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই অবস্থায় যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ভারতরক্ষা আইনের মতো একটি নতুন দমনমূলক আইন প্রণয়নের প্রয়োজন অনুভব করে।
  • মুসলিমদের ক্ষোভ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসলিম জগতের ধর্মগুরু তুরস্কের খলিফা ইংল্যান্ডের বিপক্ষ জোটের হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এজন্য যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার পরাজিত তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে খর্ব করে। তারা তুরস্কের ব্যবচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়। এতে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে।
  • বিপ্লববাদের প্রসার : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করলে সরকার অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সরকার ভারতীয়দের ওপর প্রচণ্ড দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে সংকটজনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।


রাওলাট আইনের বিরোধিতা ও গান্ধিজি

  • প্রেক্ষাপট: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতে বৈপ্লবিক ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সরকার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে 'সিডনি কমিটি' গঠন করে। এই কমিটির তৈরি আইনের খসড়াটি কেন্দ্রীয় আইনসভায় আইন হিসেবে গৃহীত হয়। এই আইনের নাম হয় রাওলাট আইন। আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতরক্ষা আইনের আয়ু শেষ হলে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীদের দমনের জন্য এক নতুন আইনের দরকার পড়ে। এই আইন সেই দরকার মেটায়।


গান্ধিজির বিরোধিতা

  • আইনের আপত্তিকর দিক: ভারতীয়দের দৃষ্টিতে রাওলাট আইনের বেশকিছু আপত্তিকর দিক ছিল। রাওলাট আইনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীদের দমনকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই আইনে বিনাবিচারে যে-কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আটক করা, তাদের বাসস্থানের ওপর নজর রাখা ও ঘর তল্লাশি করা, সম্পত্তি দখল করা, জুরি ছাড়া রুদ্ধদ্বার আদালতে বিচার করা, মোটা টাকার জামানত আদায় করা প্রভৃতি দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। পুলিশকে এই আইন রূপায়ণের জন্য বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। গান্ধিজি তাই ভারতবাসীর সার্বিক স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে এই আইনের বিরোধিতা করেন।
  • জাতীয় আন্দোলনের রূপবদল : জাতীয় নেতা হিসেবে গান্ধিজি অনুভব করেছিলেন তরুণ প্রজন্ম আর আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না। যুগবদলের সাথে সাথে পরের প্রজন্ম জাতীয় আন্দোলনের রূপ তথা পরিচালন পদ্ধতির বদল চেয়েছিল। গান্ধিজি তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টির দ্বারা এই সত্য অনুভব করেছিলেন। আসলে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমদিকের নরমপন্থী নেতৃবর্গ আবেদন-নিবেদন নীতির রাজনীতি করে ভারতবাসীর স্বার্থরক্ষায় তেমন সফল হননি। তাই জাতীয় স্তরে সরাসরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার পরিস্থিতি তৈরি হয়। গান্ধিজি এই পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
  • সত্যাগ্রহ আদর্শের প্রয়োগ : গান্ধিজির রাজনৈতিক আদর্শ ছিল সত্যাগ্রহ। সত্যাগ্রহের দুটি দিক–একটি সত্যবাদিতা ও অপরটি অহিংসা। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে শুদ্ধ তেজ বা শক্তি থাকে গান্ধিজি তাকেই বলেছেন ‘সত্যের শক্তি'। এই শক্তিরই অপর নাম 'প্রেমের শক্তি'। গান্ধিজি মনে করতেন, এই শক্তি দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় ৷ গান্ধিজি এই শক্তিকে দু-ভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, যথা— গঠনমূলক কাজে ও অন্যায়ের প্রতিশোধক হিসেবে। সত্যাগ্রহের মূল কথাই হল অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগিতা করা। গান্ধিজি মনে করতেন, রাওলাট আইন জারি করে ব্রিটিশ অন্যায় করেছে। তাই এই আন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন