সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের উত্থানের কাহিনি বর্ণনা করো।

গৌড়ের উত্থানে শশাঙ্কের কৃতিত্ব


বাংলা দেশের ইতিহাসে শশাঙ্কের উত্থান এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তিনি প্রথম বাংলাকে সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত করেন এবং ভারতের বৃহত্তর রাজনীতির অংশীদার হন। শশাঙ্কের কার্যাবলি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবুও বাণভট্টের হর্ষচরিত, হিউয়েন সাঙের বিবরণ, হর্ষবর্ধনের শিলালিপি, শশাঙ্কের আমলের মুদ্রা প্রভৃতি থেকে তাঁর সম্পর্কে কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য জানা যায়।


বংশপরিচয় 

শশাঙ্কের বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শশাঙ্কের কিছু মুদ্রায় ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ বা ‘নরেন্দ্রদিত্য' নাম পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে অনেকে মনে করেন, তিনি গুপ্তবংশীয় শাসক ছিলেন। কারও কারও মতে, তিনি ছিলেন গৌড়ের পূর্ববর্তী রাজা জয়নাগের বংশধর। রোহিতাশ্বের গিরিগাত্রে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক' নামটি খোদিত আছে । এখানে মনে হয় গৌড়রাজ শশাঙ্কের কথাই বলা হয়েছে । একথা সত্য হলে শশাঙ্ক প্রথম জীবনে সামন্ত নরপতি ছিলেন হয়ত । ডঃ বি.সি. সেন মনে করেন, শশাঙ্ক মৌখরীদের অধীন সামন্ত নৃপতি ছিলেন । তবে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলতে চেয়েছেন, ‘শশাঙ্কই প্রথম বাঙালি রাজা যিনি আর্যাবর্তে সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।' দেখাগেছে শশাঙ্ক সামান্য সামন্ত থেকে নিজ বাহুবলে বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে তাঁর রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন।


সাম্রাজ্যবিস্তার

গুপ্ত যুগে প্রশাসক ছিলেন একজন সামন্ত রাজা। গুপ্ত সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে তিনি ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ে, একটি স্বাধীন রাজা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি সাম্রাজ্যবিস্তারের নীতি নেন। তিনি কামরূপের রাজা ভাষ্করবর্মনকে পরাজিত ও বন্দি করেন। উড়িষ্যার দণ্ডভুক্তি অতিক্রম করে গঞ্জাম জয় করেন। উড়িষ্যার শৈলোধব রাজবংশ এবং গঞ্জামের মহাসামন্ত শশাঙ্কের প্রতি আনুগত্য জানায়। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলে শশাঙ্কের প্রাধান্য বজায় ছিল। পশ্চিম দিকে তিনি মগধ জয় করেন। এরপর কনৌজ দখলের জন্য শশাঙ্ক সচেষ্ট হন।


মিত্রজোট গঠন

কনৌজের সঙ্গে ইতিমধ্যে থানেশ্বর রাজ্যের একটি শক্তিশালী মিত্রজোট তৈরি হয়েছিল। তাই শশাঙ্ক জোটকে পরাজিত করার জন্য মালবের রাজা দেবগুপ্তের সঙ্গে মিত্রতা করেন। ফলে উভয়ের শক্তি বৃদ্ধি পায়।


কনৌজ অভিযান

মালবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের পর শশাঙ্ক ও দেবগুপ্তের যৌথবাহিনী ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কনৌজ রাজ আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে কনৌজের রাজা গ্রহবর্মন পরাজিত ও নিহত হন এবং থানেশ্বরের রাজকন্যা তথ্য গ্রহবর্মনের স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে বন্দি করা হয়। এই ঘটনার খবর পেয়ে থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন এবং মালবের রাজা দেবগুপ্তকে পরাজিত করেন। কিন্তু শশাঙ্কের হাতে রাজ্যেবর্ধন পরাজিত ও নিহত হন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন এবং প্রথমেই তিনি কনৌজ অভিযান করেন। হর্ষের আসার খবর পেয়ে শশাঙ্ক কনৌজ ত্যাগ করেন। এরপর হর্ষবর্ধন কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যুদ্ধে শশাঙ্ক পরাজিত হলেও তাঁর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কেননা শশাঙ্কের জীবিতকাল পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ ছিল।


শাসনব্যবস্থা

শশাঙ্কের শাসনব্যস্থা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ছিল সম্পদশালী নগর। তিনি একজন প্রজাকল্যাণকামী রাজা ছিলেন। সেচ কাজের জন্য তিনি বহু জলাশয় নির্মাণ করেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শৈবধর্মের উপাসক। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদার-সহ প্রমুখ ঐতিহাসিক এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন। কেননা তিনি বন্ধু বৌদ্ধ মঠে আর্থিক সাহায্য দেন।


মূল্যায়ন

শশাঙ্ক এক সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের যোগ্যতায় গৌড়ের অধিপতি হয়েছিলেন। তিনি রাজ্যজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাকে সার্বভৌম শক্তিত্বে পরিণত করেন। প্রাচীন ভারতে বাংলা তখন উত্তর ভারতের বিভি শক্তির অধীনে থাকত। শশাঙ্ক প্রথম ইতিহাসের দিক পরিবর্তন ঘটান এবং কনৌজ থেকে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের ওপর বাংলার আধিপতা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পাল রাজারা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। শশাঙ্ক সম্পর্কে বিবরণ যেহেতু তার বিরোধী লেখকদের তথ্য থেকে জানতে হয় তাই দেখা যায় শশাঙ্কের চরিত্রের ওপর অহেতুক কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ বিবরণের অভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...