সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বোঝো ? সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের কারণগুলি কী ?

সাম্রাজ্যবাদ

সাধারণ ধারণা: সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মত রয়েছে। প্রথমদিকে এর অর্থ ছিল সামরিক কর্তৃত্ব। পরবর্তীকালে বলা হয় একটি দেশ নিজের স্বার্থে অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশ বা সংকুচিত করে সেই দেশ ও জাতির ওপর যে প্রভুত্ব বা কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে তা হল সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism)।

সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বোঝো ? সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের কারণ কী ?


সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা

লেনিনের মত: ভি. আই. লেনিন তাঁর 'Imperialism: the Highest Stage of Capitalism' গ্রন্থে লিখেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের একচেটিয়া পর্যায়।”

হবসনের মত: জন এ. হবসন তাঁর 'Imperialism: A Study' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “প্রাথমিক স্তরে জাতীয়তাবোধ অন্যদেশে উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রেরণা জোগায়, যা পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের রূপ নেয়।” এ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মরগ্যানথাট, পামারও পারকিনস, বন, সি ডি বার্নস, সুম্যান, হিলফারডিং, কার্ল কাউস্কি, হজ, ওয়েলস এবং বেয়ার্ড সাম্রাজ্যবাদের নানা সংজ্ঞা দিয়েছেন।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য: সাম্রাজ্যবাদের নানা উদ্দেশ্য ছিল, যেমন—[i] অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ, [ii] জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ, [iii] জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, [iv] জনসংখ্যার সংকুলান এবং [v] ধর্ম ও সভ্যতার আদর্শ প্রচার।


সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণসমূহ

[1] অর্থনৈতিক কারণ : শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, পোর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশ বাণিজ্যিক কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্যিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। প্রথম দিকের এই বাণিজ্যিক লক্ষ্য পরবর্তীকালে শাসনগত লক্ষ্যে রূপান্তরিত হলে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যাবসাবাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে ভারতে এলেও পরে ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

 [2] রাজনৈতিক কারণ

 জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা: হিটলারের মতো রাষ্ট্রনায়কগণ দাবি জানিয়ে বলেন অনার্য জাতির ওপর প্রাধান্য বিস্তারের অধিকার রয়েছে আর্য জাতির। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে নিজ নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এর ফলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জার্মানির তরফ থেকে টিউটনিক জাতির, ব্রিটেনের তরফ থেকে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির, ফরাসিদের তরফ থেকে লাতিন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা হয়।

 রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা : অনেক সময় কোনো কোনো দেশ সাম্রাজ্যস্থাপনকে জাতীয় দম্ভ বা জাতিগত গৌরব বলে মনে করত। সাধারণত দুর্বল দেশগুলির ওপর আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে সবল দেশগুলিই নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।

[3] সামাজিক কারণ

 উদ্‌বৃত্ত জনসংখ্যার পুনর্বাসন: উনিশ শতক থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে। উদ্‌বৃত্ত জনসংখ্যা পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অনেক সময় বহু দেশ নতুন নতুন ভূখণ্ড দখল করে। জার্মানি, জাপান ইত্যাদি দেশগুলি উদ্‌বৃত্ত জনসংখ্যার পুনর্বাসনের অজুহাত দেখিয়ে একের পর এক দুর্বল দেশগুলির দখল নিলে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে।

জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স রাইন নদী পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কারণ দেখিয়ে জার্মানি একের পর এক অঞ্চলের দখল নেয়। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে জাপান সুদূর প্রাচ্যে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তার করে।

[4] অন্যান্য কারণ

ধর্মপ্রচার: ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ধর্মযাজকগণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ধর্মপ্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ধর্মপ্রচারের অন্তরালে তারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে বজায় রাখার চেষ্টা চালান। প্রোটেস্টান্ট মিশনারিগণ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে আমেরিকায় যান। পরে তাদের এই ধর্মপ্রচারের উদ্যোগ আমেরিকায় ব্রিটিশসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। একইরকমভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে খ্রিস্টান মিশনারিগণ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নামে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত করে দেন।

সাংস্কৃতিক কারণ: অনেক সময় পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া অংশে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলো পৌঁছে দেওয়ার বাণী শুনিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকরা সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ও সম্প্রসারণ ঘটান।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন