গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পিছনে হুন আক্রমণের দায়িত্ব
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্য। প্রায় তিন শতাব্দীকাল গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পিছনে ঐতিহাসিকগণ বহু কারণের কথা বলেছেন, যেমন—বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার ক্ষেত্রে রাজাদের অযোগ্যতা, অর্থনৈতিক সংকট, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা ঘোষণা, বৈদেশিক আক্রমণ প্রভৃতি। এই সমস্ত কারণগুলি একল্পিতভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল।
বৈদেশিক আক্রমণ
বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের একটি অন্যতম কারণ ছিল বৈদেশিক আক্রমণ। গুপ্ত যুগের বিভিন্ন সময়ে বাকাটক, পুষ্যমিত্র, চুন প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তিগুলি আক্রমণ চালিয়েছিল। স্কন্দগুপ্ত পুষ্যমিত্র ও চুন আক্রমণ প্রতিরোধ করলেও স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী দুর্বল রাজাদের সময়ে ধারাবাহিক চুন আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে নিয়ে যায়।
তোরমান ও মিহিরকুলের হুন আক্রমণ
স্কন্দগুপ্তের পরে তোরমান ও মিহিরকুলের নেতৃত্বে ভারতে হুন আক্রমণ ঘটে। তোরমান গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালান এবং এসময় উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও মালবের বেশ কিছু অঞ্চলে প্রাধান্য স্থাপন করেন। এর ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তোরমানের পর মিহিরকুল গুপ্ত সাম্রাজ্যে হুন আক্রমণ চালান। তাঁর আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলেছিল এবং এসময় পাঞ্জাব ও মালব অঞ্চল হুনদের দখলে চলে যায়। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় রাজা নরসিংহ গুপ্ত শেষপর্যন্ত মিহিরকুলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনে হুন আক্রমণ
[1] গুপ্ত সাম্রাজ্যের ওপর হুন আক্রমণের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। হুন আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়ে।
[2] গুপ্ত রাজারা হুন আক্রমণে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সামন্ত রাজারা এই সুযোগে একের পর এক স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকে। মালব, বলভী, মৈত্রক, মৌখরী প্রভৃতি শক্তিশালী রাজ্যগুলি স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে।
[3] হুনরা ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ চালানোর ফলে পশ্চিম ভারতের উপকূল অঞ্চলের বাণিজ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া হুনদের আক্রমণে গুপ্ত রাজাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে যায়।
[4] ঐতিহাসিক স্মিথ মনে করেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর বর্বর হুন আক্রমণ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ছিল এক পরিবর্তনসূচক অধ্যায়। হুনদের এই ধ্বংসাত্মক আক্রমণের ফলে ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ও রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। এইসব বিষয় লক্ষ করে বলা যায়, হুন আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।