সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ক্রিপস মিশন কী ? ক্রিপস মিশন ব্যর্থতার কারণ

ক্রিপস মিশন 

ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস্ মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ও ভারতকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত।

ক্রিপস মিশনের উদ্দেশ্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে জাপান অতি দ্রুত দ.পূ. এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে ভারতের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়। এমতাবস্থায় জাপানকে প্রতিহত করতে মিত্রশক্তির পক্ষে ভারতের সক্রিয় সাহায্য লাভের আশায় চার্চিল তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপকে ভারতে পাঠান (মার্চ, ১৯৪২ খ্রি.)। মিত্রশক্তিকে ভারত যাতে সমস্ত দিক দিয়ে সাহায্য দেয়, তাতে রাজি করানোই ছিল ক্রিপসের ভারত আগমনের প্রধান কারণ বা তাঁর প্রস্তাবগুলির মূল লক্ষ্য।

ক্রিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার কারণ

ক্রিপস প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ— 

[1] পূর্ণ স্বাধীনতা দানের অনুল্লেখ : এই প্রস্তাবটিতে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের কোনো উল্লেখ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার, বিশেষত চার্চিলের অনিচ্ছুক মনোভাব এই প্রস্তাবকে ব্যর্থ করেছিল। তিনি কখনোই চাননি ভারত স্বাধীন হোক। আসলে এটি ছিল লোক-দেখানো কৌশলমাত্র। 

[2] সংবিধান সভাকেন্দ্রিক সমস্যা:  ক্রিপস্ প্রস্তাবগুলিতে সংবিধান সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের দ্বারা নিয়োগের কথা কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়াও এই প্রস্তাবের দ্বারা সংবিধান সভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দলও ক্রিপস প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে। 

[3] ভারত বিভাজনের ইঙ্গিত : ক্রিপস প্রস্তাবে দেশীয় রাজ্যগুলির নয় কোটি মানুষের ভাগ্য দেশীয় রাজন্যবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যা আসলে প্রচ্ছন্নভাবে ভারত বিভাজনেরই ইঙ্গিত দেয়। তাই জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন — “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর ফেলপড়া এক চেক কাটার শামিল" (A postdated cheque on a crushing bank)।

[4] সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার অভাব : ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায়—কারও কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল। 

উপসংহার: ভারতবাসী ক্রিপস্ প্রস্তাবের যেভাবে বিরোধিতা করেছিল তাতে ব্রিটিশ বুঝেছিল এদেশে তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাম্‌কি বলেছেন—এই প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার জন্য সেসময়কার ব্রিটিশ রাজনীতি দায়ী ছিল। ড. বিপান চন্দ্রও এই মত সমর্থন করে বলেছেন— চার্চিল, আমেরি, লিনলিথগো ও ওয়াভেল কেউই চাননি যে ক্রিপস্ সফল হন।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...