সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গ্যালিলিওকে কেন আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয় ?

গ্যালিলিও গ্যালিলি 


গ্যিালিলিওকে কেন আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয় ?


   আধুনিক পরীক্ষামূক বিজ্ঞানের জনকরূপে সম্মানিত গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) ইতালির পিসা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণভাবে তিনি গ্যালিলিও নামে পরিচিত। বাল্যকাল থেকেই গ্যালিলিও অসাধারণ প্রতিভা ও মননশীলতার পরিচয় দেন। পুত্রের অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার কথা স্মরণ করে গ্যালিলিওর পিতা তাঁকে বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করার প্রেরণা দেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করার জন্য তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই সময় থেকেই তাঁর চিন্তাজগতে বিপ্লব দেখা দেয় এবং মধ্যযুগীয় গতানুগতিক চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি আর্কিমিদিস- এর কাজের অনুকরণে এমন একটি নিক্তি তৈরি করেন যার দ্বারা মিশ্র ধাতু সমূহের মধ্যে কোন একটি উপাদানের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। ইতিপূর্বেই তিনি গির্জায় ঝুলন্ত বাতিগুলোর দোলায়মান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দোলকের সূত্রগুলো আবিষ্কার করে সকলকে চমৎকৃত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি গণিতশাস্ত্রে প্রভূত পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদটি লাভ করেন। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি অধ্যাপনা করেন।

        অধ্যাপকের পদ লাভ করেই গ্যালিলিও বিজ্ঞান সাধনায় সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে তিনি বস্তুর অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী একটির পর একটি উদ্‌ঘাটন করতে থাকেন। বস্তুর ভারকেন্দ্র নিয়ে গবেষণার সময় তিনি হঠাৎ একদিন সাইক্লয়েড আবিষ্কার করেন। বস্তুর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অ্যারিস্টোটালের মতবাদ তিনি ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেন। বস্তুর গতি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর তাদের ত্বরণ ও জাড্য আবিষ্কার করেন। নিউটনের জন্মের অর্ধশতাব্দী আগেই গ্যালিলিও নিউটনের গতিসূত্র এবং আধুনিক বলবিদ্যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

     পাদুয়াতে অবস্থানকালে গ্যালিলিও বিজ্ঞান সাধনার এক বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি বলবিদ্যার উপর কাজগুলোকে আরও পূর্ণাঙ্গ করেন এবং ‘ভার্চুয়াল ওয়ার্ক’ নামে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। নানাবিধ সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ করা যায় এমন একটি সেক্টর আবিষ্কার করে বিজ্ঞান সাধকদের অনেকদিনের অভাব তিনি পূরণ করেন। কিছুদিন পরে তিনি দিক নির্ণয় যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তরল পদার্থের ধর্ম এবং পাম্পের কার্যপ্রণালী নিয়েও তিনি মূল্যবান গবেষণা করেন। আবার সমর স্থাপত্য ও দুর্গ প্রভৃতির নির্মাণ কৌশল নিয়েও তিনি বহুবিধ গবেষণা করেন। গবেষণালব্ধ সমস্ত বিষয়ের উপরই তিনি বক্তৃতা দিয়ে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলারও চেষ্টা করেন।

     গ্যালিলিও-র বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সর্বোত্তম পরিচয় রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে। নিজে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যালোচনা করে তিনি কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হন। কিন্তু এই তত্ত্ব গির্জার প্রচারিত ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের পরিপন্থী হওয়ায় তিনি তা প্রকাশ করতে সাহসী হননি। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে নবআবিষ্কৃত দূরবীণের সাহায্যে গ্যালিলিও আকাশের অনন্ত রহস্য দেখতে শুরু করেন। সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের সত্যতা তখন তাঁর কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পর্যবেক্ষণলব্ধ এই সব নতুন তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘The Messenger of the Stars’ নামে একটি অতি উচ্চমানের প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন। সৌরকলঙ্ক এবং নিজকক্ষের উপর সূর্যের ঘূর্ণনও তিনি আবিষ্কার করেন। ইতিমধ্যে গ্যালিলিও পুনরায় পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তাঁর আবিষ্কার বাইবেল প্রচারিত বিশ্বতত্ত্বের উপর আঘাত করতে শুরু করলে প্রাচীনপন্থীরা তাঁকে রোমে ডেকে ইনকুইজিসনের সামনে উপস্থিত হতে বাধ্য করে। সেখানে প্রাচীন ধর্মের  বিরুদ্ধাচারী বলে তাঁকে ধিক্কার করা হয় এবং তাঁকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয় যে বিশ্ব তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর সব আবিষ্কার ভ্রান্ত এবং এই সব তথ্য তিনি কখনও প্রচার করতে পারবেন না। এরপর থেকে তিনি বাকি জীবন প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে বাধ্য হন। তাঁর রচিত ‘Dialogues Concerning the Two Principal Systems of the World Dialogues Concerning Two New Sciences’ তাঁকে অমরত্ব দান করলেও এবং বিজ্ঞানের বহু মৌলিক তথ্য আবিষ্কারের জন্য ‘আধুনিক বিজ্ঞানের জনক’ রূপে স্বীকৃতি পেলেও প্রায় সমাজচ্যুত অবস্থায় মহাবিজ্ঞানী গ্যালিলিওর জীবনাবসান হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...