সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইলতুৎমিস থেকে আলাউদ্দিন খিলজী পর্যন্ত মুসলিম নৃপতিতত্ত্বের বিবর্তন আলোচনা কর।

অথবা, সুলতান শাহীর আমলে রাজতন্ত্রের বিবর্তন সম্বন্ধে লেখ।


ইলতুৎমিস থেকে আলাউদ্দিন খিলজী পর্যন্ত মুসলিম নৃপতিতত্ত্বের বিবর্তন


ইলতুৎমিস থেকে আলাউদ্দিন খিলজী পর্যন্ত মুসলিম নৃপতিতত্ত্বের বিবর্তন আলোচনা কর।

      মহম্মদ ঘুরী ও তাঁর সেনাপতিরা ভারতে পাঞ্জাব থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন। তারপর প্রায় একশো বছর সুলতানী সাম্রাজ্যকে বহু ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। অসংখ্য সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য সুলতানদের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হত।

    ইলতুৎমিস সিংহাসনে আরোহণ করেই বুঝতে পারেন যে সুলতান পদের মর্যাদা না বাড়াতে পারলে তার পক্ষে অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব। এজন্য তিনি স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এটা কার্যকর করতেও তিনি সচেষ্ট হন। সর্বপ্রথম তিনিই বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। খলিফার সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। যার ফলশ্রুতি হিসেবে খলিফার নিকট থেকে তিনি ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি লাভ করেন। খলিফার এই স্বীকৃতি তাঁকে অনান্য আমীর ওমরাহদের চেয়ে অনেক ওপরে স্থাপন করে এবং সুলতানের পদমর্যাদাও বৃদ্ধি পায়।

       ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর সুলতানের পদমর্যাদা ক্ষিণ হতে শুরু করে। রাজতন্ত্র ও অভিজাতদের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে। রাজশক্তির চরম অবমূল্যায়ণ ঘটে। রাজশক্তির প্রতি জনসাধারণের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। রাজশক্তিকে সম্ভ্রমের চোখে দেখা প্রায় লোপ পায়। এই অবস্থা ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর প্রায় ৫০ বছর ধরে চলেছিল ১২৬৬ খ্রীষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন এই অবস্থার অবসান ঘটান। তিনি রাজতত্ত্ব সম্বন্ধে নিজের ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন এবং সেটা কার্যকরও করেন। তিনি রাজার (সুলতানের) দৈবসত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন সুলতান ঈশ্বরের ছায়া, ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ সুলতান পেয়ে থাকেন। তিনি সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক। তিনি তাঁর রাজতত্ত্বের দ্বারা আমীর ওমরাহদের বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই তিনি সুলতান হয়েছেন; এ কারণেই আমীর ওমরাহদের সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখার কোন প্রশ্ন নেই। তিনি তাঁর দরবারে জাঁকজমকের দ্বারা অভিজাত ও প্রজাদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য যতটা সম্ভব বৃদ্ধি করে রাজকীয় মহিমাকে সকলের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেন। তিনি রাজার বাহ্যিক আড়ম্বর ও সম্মানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক পরতেন এবং সুসজ্জিত দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে দরবারে আসতেন। তিনি দরবারে পারসিক আদব-কায়দা প্রবর্তন করেন। যেমন সুলতানের সামনে নতজানু হওয়া, সিংহাসনকে চুম্বন করা ইত্যাদি। রাজসভায় নৃত্যগীত বন্ধ করেন। দরবারে যারা উপস্থিত থাকবেন তাঁদের পোষাক-পরিচ্ছদ কেমন হবে সে সম্বন্ধে কঠোর নির্দেশ দেন। তিনি সাধারণ  লোকেদের  সঙ্গে  কথা বলতেন না বা কোন উপহারও গ্রহণ করতেন না। এরূপ রীতিনীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করার ফলে রাজকীর মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

     বলবন তাঁর নৃপতিতত্ত্বের দ্বারা নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করলেও তাঁর বংশধরদের সিংহাসনে বসবার পথ সুগম করতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যেই তথাকথিত দাস বংশীয় সুলতানীর অবসান ঘটিয়ে খিলজীরা সিংহাসন অধিকার করে।

    বলবনের নৃপতিতত্ত্ব কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী তিনি যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করে যান সেটা  টিকে  থাকে  এবং  তার  ওপর  ভিত্তি  করেই আলাউদ্দিন খিলজী তাঁর নৃপতিতত্ত্ব কার্যকর করতে উদ্যোগী হন। এটাই বলবনের নৃপতিতত্ত্বের স্থায়ী মূল্য। 

   আলাউদ্দিন খিলজী বলবনের ন্যায় নিজস্ব নৃপতিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। বলবনের মত তিনিও সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও রাজার দৈবস্বত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ‘Kingship knows no kinship’। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে, তাঁর নৃপতিতত্ত্ব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করার জন্যই তাঁর  নৃপতিতত্ত্বের  অবতারণা করেন । তিনি সুলতানের কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করার জন্য ধর্ম এবং দল বিশেষের প্রভাবকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন  একটি  রাজশক্তির  কর্তৃত্বে  একটি সর্বক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র স্থাপন করা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এ কারণে শাসনকার্যের ক্ষেত্রে  তিনি অভিজাত  এবং উলেমাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন। ধর্ম ও রাষ্ট্র যে পৃথক দুটি সংস্থা তা তিনি বুঝেছিলেন বলেই এদুটিকে পৃথক করতে চেয়েছিলেন। একারণে তিনি উলেমাদের ক্ষমতা খর্ব করেন। আইনকানুন বলতে তিনি সুলতানের ইচ্ছাই বুঝতেন। এটা তাঁর নৃপতিতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি ধর্মনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে চাননি। 

  আলাউদ্দিন তাঁর নৃপতিতত্ত্বের সহায়ক হিসেবে খলিফার সমর্থন প্রয়োজন বলে মনে করেন নি। এদিক থেকে দেখলে তিনি বলবনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি। অর্থাৎ  আলাউদ্দিনের  নৃপতিতত্ত্ব  তাঁর  পূর্ববর্তী সুলতানদের নৃপতিতত্ত্বের চেয়ে সীমাহীন ছিল। তিনি সবদিক  থেকে  নিরঙ্কুশ  রাজতন্ত্র  স্থাপন  করতে চেয়েছিলেন। আলাউদ্দিন তাঁর নৃপতিতত্ত্ব অনুসরণ করে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হন।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কি বোঝ ?

ম্যানর ব্যবস্থা        সামন্ততন্ত্রের ভিতর থেকে তার আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে ম্যানর প্রথার বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর প্রথা প্রকৃতপক্ষে সামন্তযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, একে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ম্যানর প্রথা অনেক সময় সিনোরীয় প্রথা নামেও পরিচিত। মূলত সামন্ততন্ত্রে ভূস্বামী কর্তৃক কৃষক শোষণের যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল ম্যানর প্রথা ছিল তারই সাংগঠনিক ভিত্তি। সামন্তপ্রভু এবং ম্যানরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে।        ম্যানরের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একটি ম্যানরের জমিকে দুইভাগে ভাগ করা হত—(1) সামন্তপ্রভুর খাস জমি বা ডিমেইনে, (2) স্বাধীনস্বত্বসম্পন্ন জমি বা ভিলেইন। এই জমির মাধ্যমে কৃষক সামন্তপ্রভুর সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। সামন্ততন্ত্রের মতো ম্যানর প্রথার উৎস রয়েছে প্রাচীন রোমান ও জার্মানদের স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে। ম্যানর প্রথার প্রধান শক্তি ছিল ভূমিদাস। এই ভূমিদাসরা আক্রমণকারী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়। ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...