রাজিয়া কেন ব্যর্থ হয়েছিল ?

রাজিয়ার ব্যার্থতার কারণ 


রাজিয়া কেন ব্যর্থ হয়েছিল ?

       ইলতুৎমিস তাঁর জীবদ্দশায় কন্যা রাজিয়াকে দিল্লীর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীরূপে মনোনীত করেন। কিন্তু সুলতানের দরবারের প্রভাবশালী আমিরগণ রাজিয়ার দাবি অগ্রাহ্য করে ইলতুৎমিসের পুত্র রুকন-উদ্-দিন ফিরোজকে সিংহাসনে স্থাপন করেন। তবে রুকন-উদ্-দিন ফিরোজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুলতান, বাদাউন, হান্সি, লাহোর প্রভৃতি স্থানের শাসকগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং সসৈন্যে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন। রুকন-উদ্‌-দিন ফিরোজ তাদের বাধা দিতে গিয়ে যুদ্ধে নিহত হলে দিল্লীর কিছু সংখ্যক আমির এবং সাধারণ লোকদের সমর্থনে রাজিয়া দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন (১২০৬-১২৪০ খ্রিস্টাব্দ)।

        তবে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজিয়া সিংহাসনে আরোহণ করলেও নিষ্কলঙ্কভাবে ক্ষমতা ভোগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কঠোর হস্তে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করলে সুলতানী রাজিয়ার বিরুদ্ধে তুর্কী আমিরগণের মধ্যে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে। কুতব- উদ-দিন আইবকের আমল থেকেই সুলতানী সাম্রাজ্যের সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক সকল ক্ষমতাই তুর্কী আমিরদের হস্তগত ছিল। কিন্তু রাজিয়া দৃঢ়হস্তে সমগ্র শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে আমিরদের পক্ষে রাজিয়াকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তুর্কী অভিজাতগণ নিজেদের রাষ্ট্রের পক্ষে অপরিহার্য বলে মনে করতেন। এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীকে নিজেদের উপর স্থান দিতে রাজি ছিলেন না। বিশেষত রাজিয়া শাসনতান্ত্রিক সংগঠনের ক্ষেত্রে তুর্কীদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করেন। তিনি হাবসি জামাল-উদ্‌-দিন ইয়াকুৎকে উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। যদিও সমকালীন ঐতিহাসিক ইসামী বলেন যে ইয়াকুতের সঙ্গে রাজিয়ার প্রণয় ছিল এবং সেজন্য তুর্কী আমিরদের মধ্যে, ঈর্ষা দেখা দেয়। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক ইসামীর এই অভিমত অগ্রাহ্য করেন। প্রকৃতপক্ষে হাবসি ইয়াকুতের উন্নতি তুর্কী আমিরদের ঈর্ষার কারণ রূপে দেখা দেয়। রাজিয়ার বিরুদ্ধে আমিরদের আর একটি অভিযোগ ছিল যে তিনি পুরুষের পোশাকে এবং তাজ পরে দরবারে উপস্থিত হতেন। হাতীর পিঠে চেপে তিনি, যুদ্ধক্ষেত্রেও গমন করতেন। মুসলিম রমণীর এইরূপ আচরণ গোঁড়া মুসলমানদের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ছিল।

         রাজিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন লাহোরের শাসনকর্তা কবীর খান। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজিয়া সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন। এরপর সরহিন্দের শাসনকর্তা আলতুনিয়া প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দিল্লীর দরবারের সঙ্গে আলতুনিয়ার গোপন সম্পর্ক ছিল। রাজিয়া স্বয়ং এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিজেই তিনি বিদ্রোহীদের হস্তে বন্দী হন। তাঁর প্রিয়পাত্র জামাল-উদ্‌-দিন-ইয়াকুৎ নিহত হন। দিল্লীর আমিরগণ রাজিয়ার ভ্রাতা মুহজুদদিন বহরাম সাহকে সিংহাসনে স্থাপন করেন। অপরদিকে বন্দিনী রাজিয়া বিভিন্ন আমিরকে উচ্চপদে নিযুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন । ইতিমধ্যে রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিবাহ করেন এবং দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তুর্কী আমিরদের দ্বারা তাঁরা পরাজিত হলে আলতুনিয়াকে হত্যা করা হয়। সুলতানা রাজিয়াও নিহত হন। সংক্ষেপে বলা যায় যে সকল গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র নারী এই অপরাধে রাজিয়ার সিংহাসন ও প্রাণ উভয়ই হারাতে হয়। রাজিয়ার, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইলতুৎমিস প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন